মাছ
-বঙ্গ রাখাল
গ্রামের নাম গোলকনগর।
গ্রামটির চারিদিকে বাঁশ বাগান আর দিগন্তজোড়া ধানী জমিন। পূর্বে রাজনগর, পশ্চিমে সাধুখালি, উত্তরে যোগীপাড়া আর দক্ষিণে আলমডাঙ্গা বাজার। গোলকনগর গ্রামটি সবার মাঝে। এ গ্রামের আদী বাসবাসী দলিল উদ্দিন। এরাই সর্ব প্রথম গ্রামের গোড়াপত্তন করেছিল; কিন্তু কোথা থেকে? কবে এসে আবাস গড়েছিল তা আজ কারো জানা নেই। আর এ গ্রামের অন্য আদী বসবাসী আদিলকে তো চটা পড়া দিয়ে চোর সাজিয়ে গ্রাম ছাড়া করা হয়েছিল। এ গ্রামে সূর্যদেব প্রতিদিন সবুজের আস্তরণ ভেদ করে আলো ছড়ায়। গ্রামের বসবাসী বলতে আমরা কয়েক ঘর মুসলমান আর কয়েক ঘর হিন্দু। মুসলমানরা যেমন আনন্দোৎসব করে ঠিক হিন্দুরাও তেমনি প্রতি বৎসর দূর্গোৎসবে মেতে ওঠে। শীতের দিনে মানুষ রোদে শরীর এলিয়ে দেয়। সে রোদ সবাই মাখে তাদের শরীরে। সকালে রোদ যখন গাছের প্রকোষ্ঠ ভেদ করে আসে তখন আমরা সবাই আগুন ছেড়ে রোদের আশ্রয়ে যাই। কখনো কখনো এক পসরা বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দেয় ধানী জমিন। উর্বরা হয়ে ওঠে পাটসহ ধানী জমিনের পতিত বুক। এ বুক যখন উর্বর হয়ে ওঠে তখন হাসি ফলে কৃষকের মুখে। গ্রামটির পূর্ব-পশ্চিম কোণ দিয়ে বয়ে চলেছে খাল। এ খালটির কথা উঠলেই অনেকে বলেন খাল খননের ইতিহাস। এ খালে এক সময় অনেক মাছ পাওয়া যেত। শুষ্ক মৌসুমে খালের পানি দিয়েই তো চাষ করা হতো ধান, আখ, ছোলা, মশুড়ী, পিঁয়াজ আর পাট। বর্ষার সময় কখনো কখনো কলা ভেলায় সুখ নিয়েছে গ্রামের মানুষ। তবে এ খালের একটা নাম আছে- সে নামের কথা এখনো গ্রামের প্রবীণরা বর্ণনা করেন। খালটির নাম সোনাখাল। এ খালটির নাম সোনাখাল হওয়ার পিছনে রয়েছে বিশাল এক বিস্তৃত ইতিহাস। বৃটিশ আমল। সে সময় এদেশে নানা অন্যায় আর অঘটন চলছে। কেউ কারোর নিয়ে ভাবার সময় নেই। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যতি-ব্যস্ত। কয়েক বৎসর পরে দেশে শুরু হলো দাঙ্গা। সাম্প্রদায়িকতায় ভরে গেছে দেশ। হিন্দুরা মুসলমানদের আর মুসলমানরা হিন্দুদের সহ্য করতে পারছে না। কিন্তু এ গ্রামের মানুষ কখনো সাম্প্রদায়িকতায় জড়ায়নি। কারণ এ গ্রামে রয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। সবাই সবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এ গ্রামের ছেলে জগদীশ। সে একজন বাম ঘরানার মানুষ। জীবনের প্রথম দিন থেকেই নিয়েছে কমিউনিজমের প্রথম পাঠ। সে যেমন নিজের ধর্মকে খারাপ চোখে দেখে না, তেমনি অন্যের ধর্মকে খারাপ চোখে না দেখে শ্রদ্ধা করে। তার নাম জগদীশ হলেও সংক্ষিপ্ত নাম সোনা। বাবা-মা খুব আদর করেই সোনা বলে ডাকত। মা-বাবার খুব আদরের ছেলে হলেও কিছু কিছু গোড়াপন্থী তাকে পছন্দের চোখে দেখতো না। দিন দিন যেমন তার প্রশংসার অভাব হচ্ছিল না তেমনি শত্রুতেও ভরে উঠেছিল চারিপাশ। দেশ যখন চরম অস্থিরতার দিকে চলে যায়, তখন এক রাতে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু দু’দিন পরে দেখা যায় খালের পানিতে মাজায় ইট বাঁধা অবস্থায় ভেসে আছে। সর্ব প্রথম শফিউদ্দিন প্রাকৃতিক কাজে সাড়া দিতে গিয়ে এ লাশকে দেখেছিল। অতঃপর দলে দলে লোকজন আসতে শুরু করে। সেদিন থেকেই খালের নাম রাখা হয় সোনা খাল। এ খালে এখনো মানুষ দলে দলে পাত জাল, ঠেলা জাল, থুরকুচ, ট্যাটা, পলো নিয়ে আসে মাছ ধরতে। বর্ষার মৌসুমে নতুন পানিতে নতুন নতুন মাছ আসে, হরেক রকম মাছ। এ নতুন বর্ষার পানিতে যে শুধু মাছই আসে তা কিন্তু নয়। মাঝে মাঝে শিশুও আসে। সেদিন খালের পানিতে জরিনার মা ২-৩টা শিশুকে গা ভাসাতে দেখেছে। গোসল করার ঘাটের পূর্ব পাশে হিন্দুদের শ্মশান। এ শ্মশানে গ্রামের মানুষ রাত্রে বিড়াল, কুকুর, মহিষ, খেঁকশিয়ালকেও ঘুরে বেড়াতে দেখেছে। এ সব গল্প শুনতে শুনতে সবার মনে একটা ভীতির তৈরি হয়েছিল। এমনকি এখনও গোসল করতে গেলে গা ছম্ছম করে।
খালে সব সময় যে পানি থাকে তা কিন্তু নয়। এ খাল শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে যায়। এটি যে খাল তা আর তখন মনে হয় না। মনে হয় যেন নিচু কোন পতিত ভূমি। আবার বর্ষার পানিতে খালসহ গ্রামের চারিপাশ যৌবনা হয়ে যায়। এ সময় গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি বাঁশি আর রাজা পাতজাল নিয়ে মাছ ধরার জন্য খালে পরেই থাকে। কোন কোন দিন দেখা গেছে তার নাতী-নাতনী ব্যাগে করে ভাত নিয়ে এসেছে। শুধু কি তারাই! গ্রামের অনেকেই পড়ে থাকে খালের পাড়ে। এ মানুষগুলো যেমন মাছুরে তেমনি মাছ পাগলা। কোন কোন বৃদ্ধ আবার মুখে পান পুরে পিকের গতীতে খালের পানি লাল করে দেয়। পুল্লাদ জেলে মাঝে মাঝে মাছ মেরে গোলকনগরের বটতলার হাটে ছিড়া-ফাঁটা পলিথিন বিছিয়ে কয়েক পোয়া টাকি, কিছু পুটি আর কিছু সিলভারের পোনা নিয়ে বসে থাকে। বর্ষা মৌসুম এলেই মাঝে মাঝে আলমগীর পঁচা পুঁটি মাছের ব্যবসা ধরে। নজরুল কাকা তো কার্তিক মার্কা দেহ নিয়ে ‘টো’ ধরে বসে থাকে বটতলার হাটে, সায়েবের দোকানে। মাঝে মাঝে এ খালে সাজ্জাদ, তিতুমীরও তাদের পাতজাল, কারেন্ট জাল পেতে রাখে। কিন্তু যেই বর্ষা চলে যায়, সেই খাল শুকিয়ে যায়। এসময় মানুষ ধান বোনে। ধানের ঢেউ তখন জল ঢেউ এর মত নিত্য নতুন ছন্দে নিজেকে মাতায়। এবার শুষ্কের সময় তবুও খালে স্যাঁত, স্যাঁতে পানি রয়েছে। মাঝে মাঝে পট এসেও ভিড় জমিয়েছে সামান্য পানিতে। সেখানে আবাস গড়েছে ব্যাঙ আর কাঁকড়া । কিছু ব্যাঙের রেনু পোনাও কিলবিল কিলবিল করে বেড়াচেছ এ জমে থাকা পানিতে। পানি পোকা একবার এদিক থেকে ও দিকে ছুটাছুটি করছে। দোলা আর দোখায় এসেছে মাছ ধরতে । তারা এ গ্রামেরই সন্তান। সম্পর্কের দিক থেকে দোলা দোখাইয়ের ছোট বোন । দোখায় দোলাকে খুব আদর করে তাই তো ছোট বোনকে সঙ্গে করে এনেছে। দোখাইয়ের বয়সও বেশি নয় মাত্র ১০-১১ বছর হবে। এ জমাট বাঁধা কাদাজলই তারা ছাকবে।
-দোলা তুই দাড়াই থাক । নিচেয় নামবি না।
আচ্চা।
দোখায় জল ছাকা শেষ করে কাদা থেকে পট তুলে দুরে ফেলে দেয় । হঠাৎ পটের মধ্য থেকে একটা ঢোড়া সাপ পালিয়ে যায়। দোলা চিৎকার করে উঠে, ভাইয়া ছাপ, ছাপ। দোখায়ও ভয়ে ভয়ে কাদা থেকে উঠে আসে। সাপ দুরে চলে গেলে সে আবার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে কাদায় নেমে মাছ ধরে । এবার ও পট তোলার সাথে সাথে কিলবিল করে কাদা ছুড়তে ছুড়তে পালাতে গিয়ে কাদায় দেহ লোকায় মাছটি। দোখায় ভীত ভাবে তাকায় মাছটির দিকে, না, সাপ না, টাকি মাছ ।
-ভাইয়া মাচ
-হ্যাঁ
-আমি খাব
আচ্চা।
দোখায় খালই ভরে পুঁটি, টাকি, চিংড়ি, পাবদা, ডানকানা, তেলও মাছ ধরেছে । চল দোলা বাড়ি যায়। তাই বলে দোখায় দোলার হাত ধরে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। দোখার সারা শরীর কাদায় ভরা। দেখতে অনেকটা ভূতের মতো মনে হচ্ছে। তাইতো তার মা চিনতে পারেনি। কে দেউড়িতে ভুকচি মারছে। এ কথা শুনে দোলা মায়ের কাছে ছুটে এসে বলে মা, ভাইয়া, তোমার ভয়ে বাড়ি আচছে না, ভাইয়া মেলা মাছ মারেছে । কই দেখি, দেখি! মা ছুটে গিয়ে দেখে এক খালই মাছ। ওরে আমার সোনারে কত মাছ মেরেছে, দে আমার কাছে, যা গোসল করে আই। দোলার মা ফুলবানু মাছগুলো হাতে নিয়ে চুলার ছাই আর বটি এনে মাছ কুটতে লেগে যায়, এমন সময় পাশের বাড়ির কালার মা আসে। কি রে, দোখার মা মাছ কনে পালি, তোর পোলা বুঝি এনেছে ।
-হ্যাঁ। পোলা ছাড়া আবার কিডা আনবি । ও মিনসের কি মুড়দ আছে ছাওয়াল পালের এক পোয়া মাছ কিনে খাওয়াবি।
-কি করবি গরীব মানুষ, সেও তো কম চেষ্টা করে না, তাও তোর পোলা আছে বলে মাছের মুখ দেখছিস । আমার আর কিডা আছে যে, মাছ আনে দেয় , ছিল এক সোয়ামী আর এক পোলা। সোয়ামিডা টাকার জন্য গ্রাম ছাড়ল, ঐ যে ঢাকা গেল আর ফিরে এল না, মনে হয় ঢাকা আর একটা নিকে করেছে। সে জায়গা তো গারমেনসের মিয়ার অভাব নেই। যেন খাজা বাবার দরবার। কেউ খালি হাতে ফেরে না। এডাইতো পুরুষের ধর্ম ভাল নারী দেখলেই লাফায়ে ওঠে। দোলার মা বলে, কথায় কয়না কাঁচা টাকা আর নারী দেখলে পুরুষের মন আন চান করে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কালার মা। অনেক সময় পর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে দোখার মা। আবার বলে ওঠে তুমি যে সন্তানকে বুকে করে জীবন পার করবে তাও নিয়ে গেল খোদা। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে কালার মা। আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে বলে-সেবার পোলাডা খাল থেকে মাছ মেরে এনে আমার বলেছিল মা নে, ভালো করে পুঁটিগুলো ভেজে দে, জামাইভাজা পুঁটি। যত সময় আমি মাছ কুটলাম ততো সময় ও বসে ছিল আমার পাশে । আর বার বার বলছিল আমি জামাইভাজাপুঁটি খাব। বাজান টাকি আর তুই ডানকানা মাছ খাবি । মা, আমি যদি না থাকতাম, তোর মাছ আনে কে দিত ? তুই মাছ কনে পাতি ? একথা শুনে আমি হাও মাও করে কাঁন্দে উঠি । তুই এ কথা কচছিস ক্যারে কালা। এমনি মা, মিছে মিছি কলাম। এর পর একদিন কলেরা হয়ে ও মারা গেল । কত হাকিম, কবিরাজ দেখালাম কিছু হলো না । দোলার মা বলে-মানুষ কয় রে বু মরণের কথা চরণে কয় । হয়তো ও চলে যাবি বলে এ কথা বলে গেল, তুমি এখন এ কথা মনে করবা আর কালাকে স্মরণ করবা । এ কথা বলতে বলতে মালসায় মাছ নিয়ে পা বাড়ায় ফুলবানু নলক‚পে যাবার জন্য আর কালার মার উদ্দেশ্য করে বলে বসো, বু, আমি মাছ ধুয়ে আসি।
-না রে আমি গেলাম ।
সন্ধ্যা লাগি লাগি ভাব, এমন সময় দোখার বাবা হাকিম বাড়ি ফিরেছে। সে ফুলহরির বাজারে মনিহারি দোকান দেয়। সেখানে ফিতা, টিপ, ঘুনছি, আলতা, সোডা, সাবান, কানের দুল, চুড়িসহ নারীর সাজার জিনিস বিক্রি করে । সে বাজার থেকে এসে হাত ধুয়ে ঘরে ঢুকছে, এমন সময় রান্না ঘর থেকে ডাক এল, খেতে এসো, ডাকে দোখার মা। ভাত খেতে বসে হাকিম। পাতের মাছে চোখ পরতেই চোখ আটকে যায় হাকিমের। আঁৎকে ওঠে হাকিম। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে জল । মনে ভেসে ওঠে নানা কথা। আমি কেমন বাবা ছেলে মেয়ের কোন ভালো খাবার খাওয়াতি পারিনে। বড়লোকরা তাদের ছেলে মেয়েদের কত কিছু খাওয়ায়, আমরা কেন পারিনে আল্লাহ্। মাছের বাজারে গিয়ে মাছের দাম শুনে চলে আসি , মাছ কিনতে পারিনে। মাছ যে মারে খাওয়াব তাও আগের মত নদ নদীতে পাওয়া যায় না। চেনেখালির দোআয় আগে মাছ পাওয়া যেত এখন সেখানেও মাছ নেই। নানা কথা মনে পড়ে আর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে জল। ঘাড়ের ঘামছা দিয়ে বার বার চোখের জল মোছে হাকিম। দোখায় বলে বাবা তুমি কাঁদছো? তখন হাকিম হু-উ-হু-উ করে কেঁদে ওঠে। তোদের আমি ভাল খাবার মুখে তুলে দেবো কি করে? সংসারই তো ভালভাবে চালাতে পারিনে। আমারও তো মন চাই ভাল জিনিসটা আমার মেয়েকে দিই, ভাল খাবার আমার ছেলেকে খাওয়ায় কিন্তু পারিনে, আমরা যে গরিব। পাশে ঘুমিয়ে ছিল দোলা, বাবার কান্না শুনে উঠে এলো। গিয়ে বসল বাবার কোলের ওপর। এত সময়ে ঘুমিয়ে পড়েছে দোখায়, দোলাও ঘুমিয়েছে বাবার কোলে। হাকিমের স্ত্রীও পিঁড়িতে বসে ঝিমুচ্ছে। হাকিম কার ও দিকে ভ্রক্ষেপ না করে মলিন বদনে নিষ্পলক নয়নে চেয়ে আছে আপন গতিতে জ্বলা কুপিটার দিকে। কুপিটা মাঝে মাঝে বাতাসে দোল খাচ্ছে। চেয়ে আছে হাকিম। গড়িয়ে পড়ছে নয়ন বেয়ে অশ্রু…