পরীবৃত্তান্ত কিম্বা একটি তালগাছ
শারদুল সজল
যৌবন একটা জ্যান্ত বাঘ!
শুধু কামড়ায়-
তাই বলে ওই ছাওয়ালের লগে? কমপক্ষে বিশ বছরের ছোট হবে রমিজ,দুই সপ্তাহ আগে টুঙ্গি টু মতিঝিলের সাতাইশ গাড়িতে হেলপারের চাকরি নিয়েছে, তার সাথে বাছাতন এই দিন দুপুরে শুইতে পারলো! ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে পরী।
এইটা তুমি কী করলা খালা?
মুখ ফিরিয়া জবাব দ্যায় বাছাতন- বেশ্যা তো আর অই নাই।
তয় এ্যাইটা কী?
একথা তুমি কইবাই জানি, তয় লিপিস্টিক-পাউডার ম্যাইখা তিনতলায় তো আর খাড়াই না!
পরী রেগে যায়, তুই আমারে নিয়ে একটা কথাও বলবি না, কইছি
কলে কী তোর মান যায়, ম্যানষে যে কয়…
ক্যাডায় কয়? ক্যাডায় কয়?
রাগে গড়গড় করে হাতের ব্যাগ চেপে ধরে রাগ সামলানোর চেষ্টা করে পরী।
বাছাতন গলা চালায়, ইজ্জত দেহাইলে একহানে দেহাইছি, দশহানে না…
পরী কথা না বাড়িয়ে রাস্তার দিকে হাঁটতে শুরু করে, দক্ষিণে মোড় ঘুরে কাচাবাজারের আগেই রিক্সায় উঠে সে। প্রথম দিকে সবাই জানতো সে গার্মেন্সে চাকরী করে। হঠাৎ কিভাবে যেন এক কান ,দুই কান হয়ে গেল। অনেকেই এখন আড়চোখে তাকায়, সন্দেহ করে, বুঝতে পারে পরী। ভাবে, নিজে বাঁচলে জগৎ বাঁচবে, কার কী খাই আমি?
ভাবনাকে পাত্তা দেয় না সে। তবে মাঝে মধ্যে ক্ষেপ্তি ধরে- আমি কী করুম, কী করুম না, তাতে ম্যানষের কী?
পানের দোকান থেকে জসিম ডাক দ্যায়-ওই পরী, দুপুর বেলা কই যাও?
পরীর রাগটা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। আমি কই যাই, না যাই তাতে তাগর কী? ক্যান, কহনও তো কইলো না, পরী-কী খাইছো,ক্যামন আছ? সুখÑদু:খ সুবিধা অসুবিধা। তয় আমার যাওয়া, না যাওয়া নিয়া ওগোর এতো মাথা ব্যথা ক্যান, সব শালার পুত একটা লুইচ্ছা…ঘরে বউ রাইখ্যা বাইরে মাগির কাছে যায় আর সব দোষ হয় মাগি গো!
পরী একটা ঝাঁকুনিতে হঠাৎ টের পায়, রিক্সায় বেশি চলে এসেছে ঘুরান, ঘুরান পেছনে থুইয়া আইছি
কোন হানে থাকেন আপা ?
ক্যানে?
না,এমনেই
পরী বুঝতে পারে,ওর কথার সুরত দ্যাইখা রিক্সাওয়ালা সাহস পাইছে, ফ্রি হইতে চায়। চেহারা-শরীর তার ভদ্রম্যাইয়া গো নাহালি ছিল। শুধু যদি একটু সুন্দর করে,শুদ্ধকথার ঢং দিয়া কথা কইতে পারতো-তবে সেও প্রিয়াংকাদির মতো কলেজের কথা বলে ভি আই পির সুবিধা নিতে পারত,কাষ্টমারদের ভয় দেখাতেও অসুবিধা হতো না। সবাই সম্মানও করত। প্রথম প্রথম চেষ্টা করেছে-কিন্তু পারেনি। ভদ্রলোকেরা ওর কথা শুনে হাসে, মজা পায়। প্রথম দিকে দু-একদিন বলেছিল কলেজে পড়ে, তাতে কাষ্টমারদের আগ্রহ ও আকর্ষণ বাড়তো। ক্যান বাড়তো- তা সে জানে না। তবে কলেজের কথায় কিছু ঝুক্কি ঝামেলাও বাড়ে। কোন কলেজে পড়ে, সাইন্স-ফাইন্স,না আটস-এগুলান জিগায়। কোন উত্তর করতে পারে না সে। তখন অনেকেই মুচকি মুচকি হাসে, ওই হাসিটা বড় ঘেন্না লাগে, মনে হয় খুন্তি পুড়িয়া গায়ে ছ্যাকা দিচ্ছে। অপমানের আর শেষ থাকে না। কেউ ব্যক্তিগত কথা তুললে তারা দ্যায়¬ ‘তারাতারি কাম সারেন মিয়া,পুলিশ আইব’ তখন চোদানির পোলারা ঘাবড়ে যায়।একবার এক পুলা পুলিশের কথা শুনে জ্যাইংগা ফেলেই প্যান্ট পরতে শুরু করে
কি কাম করবা না?
না, বাবা আসতে পারে
বাবা আসতে পারে মানে ?
এই নাও তোমার টাকা- বলেই ছেলেটি দৌঁড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। কথাটা মনে পড়ে খিলখিল করে হেসে উঠল পরী। এ হাসি তার দীর্ঘস্থায়ী হয় না, চিপা গলির অন্ধকার দিয়ে রিক্সা এগিয়ে চলছে। এ চাকরি এখন আর তার ভাল লাগে না।
রিক্সা থামে। মুখে উড়না দিয়ে ঢেকে দৌঁড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠে। যেন কেউ দেখতে না পায়। অথচ ভেতরে গিয়েই টান টান বডি, ব্যাঙের মতো আকর্ষণীয় করে পাছা ফুলিয়ে দেখানো, সেক্সুয়্যাল মুখাবয়ব, ইশারা …ভাবে পরী, এই ভাবে আর কয়দিন!
কী রে পরী, কী ভাবতাছস?
কিছু না,
চল তিন তলায় যাই…নতুন ম্যাইয়া আনছে-দেখবি
না, তুই যা-
হঠাৎ কাঁধের উপর একটা হাতের চাপ লাগলে পেছন ফিরে তাকায় পরী
কী অইছেরে, কাম করলি না যে? দাঁত বিজলিয়ে জিজ্ঞাস করে হুরমুজ
কাম করমু কি করমু না -তা কি তোমারে কইতে অবো
অমন চুপা চুদাস ক্যানে, বিগাড় উঠছে নি
সরো, সরো তো- হুরমুজকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় পরী।
পানদাইতা হুরমুজ দালালকে একদম সহ্য হয় না পরীর। মেয়েদের বুকঘেঁষে হাত চালিয়ে খুঁচানোটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মাঝে মাঝে আবার বলে -কীরে, ঢিলছে ক্যানে?
একবার রেশমি বলেছিল, তোর মাকে জিগাইতে পারস না -ঢিলছে ক্যানে…।
বিরাট তুলকালামকাণ্ড বেঁধেছিল সেদিন। কথা না বাড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে রইল পরী।
পাশের মেয়েটি কাষ্টমারকে এক নাগারে বকে যাচ্ছে-চুদানির পুলা, খানকির পুলা…। এরকম চিৎকার চেচামেচি প্রতিদিনই চলে তবে আজ কেন যেন তার শরীর মন কোনটাই চলছে না। মনের বিরুদ্ধে ,শরীরের বিরুদ্ধে যদিও তাকে প্রতিদিনই শুতে হয়েছে কিন্তু আজ কোনভাবেই সায় পাচ্ছে না।
পরী উঠে দাঁড়ায়,তখন সন্ধ্যা।
আকাশ প্রচন্ড কালো হয়ে আছে। মাঝে মাঝে বিজলী চমকাচ্ছে,তাতে রাস্তা ও দূরের বিল্ডিংগুলো হলুদ আলোতে চকমক করে ,বাতাসও উঠছে বেশ। পরী রিক্সাওয়ালাকে তারা দ্যায়- একটু জোড়ে চালান না ভাই ,ঘরে ঢুকা মাত্রই প্রচন্ড ঝড় উঠলে পাশের ঘর থেকে চিৎকার করে জমিলা-আল্লাহ রসূলের দোহায় লাগে, ঘরটা আমার ভ্যাঙ্গো না , ভ্যাঙ্গো না …
পরী জোড়ে ডাকে,খালা- চইলা আহো।
জমিলা যেন ঘর রেখে আসতেই চাইছে না। পরী আবার ডাকে -তোমারে উড়ায় নেবু খালা , আহো এহনি।
জমিলা দৌঁড়ে পরীর ঘরে ঢুকে। তারপর শরীরের কাপড় ঝার দিয়ে আক্ষেপ করে- ঘরটা বুঝি আর রক্ষা করতে পারলাম না রে পরী!
একটু পরপর দরজা খুলে নিজের ঘরের দিকে তাকায় জমিলা…
বৃষ্টির হেছা আইতাছে তো খালা-ভেতরে আহো। দরোজা আটকায় পরী। তোমার ঘরের কিছু অইলে আমি বানিয়ে দিমুনে। এখন বও।
কেঁদে ওঠে জমিলা। আমার ম্যাইয়া বাইছা থাকলে তোর নাহাল অইতো। মায়ের কথাও মনে পড়ে পরীর। মাই যখন নতুন কোন বাসায় কাম লইতো তখন হগলে কইতো- ও বুয়া, ম্যাইয়াডা কী তোমার নাকি? বিশ্বাস করতে চাইতো না অনেকে। মায়ে আমার হাসতো আর কইতো, এই পেটের থলেতে দশমান ধরছি গো বু। চোখ লাগাইন না, বলেই আমার গায়ে থুতু ছিটাইয়া দিত। চোখ বেয়ে টপটপ অশ্রু গড়িয়ে পড়ে পরীর। জমিলা আবাক হয়, কান্দস ক্যান পরী? পরী কোনোমতেই তার কান্দা থামাতে পারে না।
মাই আমার নিয়া কত কষ্ট করছে গো খালা, বাসায় সাহেবরা আমারে নষ্ট করবো বুইলা মাই আমার সব কাম ছাইড়া দিল।
আদ্রকন্ঠে শান্তনা দেয় জমিলা, কান্দিস না পোড়া কপালি, কান্দিস না।
মা আমার ভাত না খাইয়া ,ওষুধ না পাইয়া মইরা গেলো। বিছানা থেকে লাফিয়ে ওঠে ট্যাঙ্ক খুলে পরী। এই দ্যাখো খালা-আমার এহন কত টাকা, শুধু মাই নাই। বাইরে তখন প্রচন্ড ঝড় হচ্ছে ,সেদিকে কারো খেয়াল নেই। মনের ঝড় টর্নোডো, সিডরের চেয়ে ভয়াবহ।
চুপ কর পোড়া কপালি- চুপ কর। চোখ মুছে পরী। চোখ মুছে জমিলা ।
হুন, কদইমা না তোরে পছন্দ করে, ওরে তুই বিয়ে কর-জীবনটা সাজা
এই কথা ক্যামনে কও খালা?
ক্যান দোষের কী?
ও একটা হারামির বাচ্চা, গেল বউ ক্যান খেদাইছে ,ভুইলা গেছো ?
এহন ভাল হইয়া গেছে
কত ঘুষ খাইছো, বাইরও এহনি আমার ঘর থেকে
এই ভাবে জীবন যাইব রে মা?
তয় কী কদইমা বিয়া কইরা একটা বাচ্চা ধরামু, তারপর আমারে ফালাইয়া চইলা যাইবো। আমি মায়ের মতো ম্যানষের বাসায় কাম করুম আর সাহেবরা সুুযোগ বুইঝা আমারে বিছানায় নিয়া ছিলাইবো। তারচে, এইটাই আমার ভাল।
ততক্ষণে ঝড় থেমে গেছে। দরজার কাছে এসে ডাক দেয় বাছাতন-
পরী, এই পরী -ম্যাচের একটা কাটি দেনা।
কাটি- টানি নাই
একটা দে , আবার চায় বাছাতন-
কথার বোমা ফাটায় পরী ,আমি না বেশ্যা, আমার মুখ দেহন পাপ, কাটি নিলে পাপ অবো না।
একটু থতমত খায় বাছাতন। একথা কী আমি তোরে কই?
তয় ক্যাডায় কয় ?
কয় তো জমিলা
ঘরের ভেতর থেকে চিল্লাইয়া ওঠে জমিলা -ঐ মাগি আমারে ভরাস ক্যান
বাছাতন গলা ছাড়ে, ক্যান, তুই ফালানির মারে কস নাই?
দরজা খুলে এগিয়ে যায় জমিলা। বাছাতনের চুলের মুঠি ধরে হেঁচকা টানে মাটিতে ফেলে দ্যায়। বাছাতন মাটিতে পড়ে জমিলার কাপড় টেনে ধরে। ফুলির জীর্ণ কাপড় একেবারে দুইখান হয়ে যায়। বাছাতনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে জমিলা। চিৎকার করে বাছাতন- ও আল্লাহ ম্যাইরা ফালাইলো গো… ম্যাইরা ফালাইলো। পরী এসে দুজনকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে। পাশের ঘর থেকে রিক্সাওয়ালা মেনহাজ দৌঁড়ে আসে-কী করো, কী করো তোমরা,জ্যাংটা দিয়ে জমিলাকে ছাড়িয়ে নিল। কাদায় একাকার হয়ে গেছে সবাই। বাছাতন হাফাতে হাফাতে উঠে দাঁড়ায়। তোর উপরে আল্লার ঠাটা পড়বো।
হস্তদস্ত হয়ে কোথা থেকে যেন কদম এল,কী অইছে পরী? তোমার শরীরে কাদা ক্যান?
না শুনার ভান করলে কদম একটু অপমান বোধ করলো
একেবারে দেমাগের আটখানা।
কোন কথা বললো না পরী। থেমে থেমে আরও কিছুক্ষণ মুখের বুলডোজার চলল। রাতের শেষ ট্রেন চলে গেছে অনেকক্ষণ।
গভীর রাতের ট্রেনটা একবারে আযরাইলের মতো আসে। যদিও আযরাইল সে কখনো দেখেনি, তবে শুনেছে গতরের বেবাকটা টেনে ছিঁড়ে লুকানো আত্মাটারে খপ করে ধরে বাইরে নিয়া যায়। ট্রেনটাও সে রকম কইরা আসে, চারপাশ কাঁপিয়ে, কী গতিতে যে আসে- মনে হয় ট্রেন এই ঘরের উপর দিয়াই যাবে,নাকি সে ট্রেন লাইনের উপরেই শুয়ে আছে। নয়তো আজ অমন শব্দ অবো ক্যান। ছোট বেলায় ভয় লাগতো, এখন আর লাগে না বরং অবাক হয়, ট্রেন এই ঘরের উপর দিয়ে একবারও গেল না। ক্যান যায় না,তাও সে বুঝে না। তবে খুববেশি কষ্ট হলে মনে মনে বলে, ট্রেনটা যেন আজ এই ঘরের উপর দিয়া যায়, শেষ করে দিয়া যায় সবকিছু…কিন্তু যায় না। তাইতো আজও সে বেঁচে আছে। তবে এ বেঁচে থাকার মানে সে বুঝে না। তবে কী শেষ মেষ কদইমাইরে বিয়ে করতে অইব? নিজের ভেতর থেকে অস্পষ্ট এক ঘেন্না বেরিয়ে আসে,কানা, লুলারে সে বিয়ে করবে তবু কদইমারে না। বামকাত ঘুরে ঘুমানোর চেষ্টা করে পরী। হঠাৎ ঘরের বামপাশে পরপর কয়েকবার পায়ের শব্দ হলো, খেয়াল করলো ভাল করে, হ্যাঁ, কে যেন হাঁটছে, এতো রাতে কে? তাছাড়া ওদিক দিয়া তো রাস্তাও না। টিনের ফুটো দিয়ে তাকায় পরী। হ্যাঁ, একটা ছায়া, একদম তালগাছের মতো, মাঝে মাঝে নড়ে উঠছে, এবার সত্যি সত্যি ভয় পায় পরী!