www.draghima.online
-তাইন তো ছাতাইলাইলা রেবা!
ছহিফা বিবির কথায় আজমল আলী কিছুই বোধ করতে পারে না, তবে অনুমান করে পূবের আউন্দা-পুকুরের ‘তিনি’ আবার খোয়াবে দেখা দিয়েছেন হয়তো। কিন্তু সেসব তো অনেক দিন থেকে আর শোনা যাচ্ছিলো না! নাকি সে দেশে নাই বলে এসব খবর তার কাছে আর পৌঁছায়নি?
খালার কাকুতি মেশানো দুশ্চিন্তার খবরে সেও এবার সমীহ মেশায়-তাইন কিতা স্বপ্নে আরবার দেখা দিছইননি, খালা?
ছহিফা বিবি বয়সের ভারে কানে কম শোনায় অনেক কথাই জুরে বলার পরও ঠিক ঠিক বুঝতে পারেন না, অথচ আজমল আলীর এই ফিসফিসানি তার কানে ঠিকই পৌঁছায়। ভরা আসর-ওয়াক্তে এসব কথা আরো গোপনে বলতে হয়-ছহিফা বিবির নাই-হওয়া গলা বেয়ে শৈশবের ভয় পুনরায় তাকে ঝাঁকুনি দেয়। সেই কবে থেকেই সে শুনে আসছে সময়-অসময় বুঝে এসব নিয়ে কথা বলতে হয়, তাছাড়া মুখে যেন নাম না-আসে, আর কথা বলতে হয় তমিজের সাথে। এসব কারণে খালার বাড়ি মাকে নাইওর আসতে শুনলেই ভয় তাকে জড়িয়ে ধরতো। তাদের পুকুর তো আর পুকুর নয়, ওই পুকুর শাসন করেন ‘তিনি’। অতএব দুুপুর-সন্ধ্যা তো প্রশ্নই উঠে না, যে কোনো সময়েই সে-পুকুরের আশেপাশে যেতে মানা থাকে। যেখানে বড়দেরকেই গাছগাছালির ভিড়ে হিম-শীতল পানি দূর থেকে ভয় ছড়ায়, সেখানে সে আর কোন ছার! এ-পুকুরে কেউ মাছ ধরবে-তো দূরের কথা, হাত-মুখ ধুতেই কেউ সাহস করে না। এ-পুকুরের মাছ কী আর সাধারণ মাছ, তারা তো সব ‘তিনি’র শিষ্য! বাস করেন তারা পাতালনগরে, অন্যসব আগুনের মাছ তাদের পড়শি হয়ে থাকে। এ-পুকুরের নিচ দিয়ে গোপন পথ কি আর শুধু পাতালে গেছে? গেছে তো শাহজালালের মাজারে। তা না-হলে ভরদুপুরে গাছের গুড়ি হয়ে এতো এতো গজার মাছ মাঝপুকুরে ভেসে বেড়ায় কেমন করে! আর দেখো সাত গ্রামের সাহসী জাইল্লাও জাল ফেলে একটা পুঁটি মাছও তুলে আনতে পারে না, বরং সাতদিন জ্বরে ভোগে। পুকুরে কলার শিন্নি ভাসিয়ে দিলে তাবেই না রক্ষা! কার এমন বুকের পাটা যে পুকুরের আর আশপাশে যায়! আজমল আলীর কি আর সে-সাহস আছে? মিঠু সাহস দেখিয়ে কি পাড় পেলো? ভরদুুপুরে কতো করে মা মানা করলেন, শুনতে চাইলি না। পুকুরপাড়ের ডেফলি-আমের লোভে যেতে চাস যা, তাই বলে মুতে যে পানি নেছ নি, তা কি মনে রাখবি না? এতে যা হবার তাই হলো, সন্ধ্যাবেলা পাতলা পায়খানা করতে-করতে মারা গেলো সে। ছহিফা বিবি পয়লা সন্তান হারিয়ে পাগল-প্রায় থাকলেন অনেক দিন। সময়-অসময়ে ছেলের দুঃখ উঠলেই মাতম করে পুকুরের দিকে ঢিল ছুঁড়তেন। হোক না পাগল, তাই বলে কি বেয়াদবি সহ্য করবেন ‘তিনি’? পরপর দু-দুটি ছেলে সন্তান চোখের নিমেষে নাই হয়ে গেলো। একটা পড়লো পানিতে, অন্যটা কথা নাই বার্তা নাই ধুমপোড়া জ্বরে। পরেরটা গর্ভেই মারা গেলে ছহিফা বিবির জীবন আটকে রাখতে থানা শহরে দৌড়াতে হয়। এ-যাত্রা হয়তো ‘তিনি’ মাফ করে দিলেন, নইলে কি আর থানা সাস্থের কেন্দ্রের বড় ডাক্তারের বাপের সাধ্যি আছে যে পেট কেটে বাঁচিয়ে রাখে?
ছহিফা বিবি তা বুঝতে পারলেন। অন্যদের বুঝতেও কি আর বাকি থাকলো? কালাপুরের কোন লোক আছে যে বলবে না, এ-পুকুরে বনসুপারির ঘাট একদিন দেওলা হয়ে মাঝপুকুরে ভেসে থাকতে-থাকতে নাই হয়ে যেতে দেখেনি? জুম্মাবারে মাঝপুকুরের পানি এতো উত্তাল হয় কী আর সাধে! আর মধ্যরাতে এতো বাধ্যি বাজে কোথা থেকে? ছহিফা বিবি সাত-গরুর সিন্নি দিয়ে মাফ চাওয়ায় ‘তিনি’ সদয় হয়ে খোয়াবে আসেন। অবশ্য খোয়াব দেখেন কেরামত মিয়া। ছহিফা বিবির গর্ভে আবার সন্তান এসেছে। চিন্তায় তার ঘুম নাই। মধ্যরাতে কেরামত মিয়া ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠে পানি চাইলে মুখে তার অন্ধকার ঘনায়।
-কিতা অইছে তোমার?
-তাইন স্বপ্নে আইছলা…
কেরামত মিয়ার কথা আর আগায় না। দম তার আটকে যায়। তেল-পানি দিয়ে পিট-গলা ঢলে দিলে একসময় দম তার স্বাভাবিক হয়, তবে বউয়ের শত কথায়ও মুখ খুলে না। শুধু সকাল হবার ইঙ্গিত আসে। কিন্তু সকাল-তো আর হতে চায় না, সাতশ রাত মনে হয় জোড়া লেগে আজকের রাত শেষ হবে। বাকি রাত কাটে তাদের অনিদ্রায়। ফজরের নামাজ শেষে তার মুখ খোলে-কাল রাতে ‘তিনি’ স্বপ্নে এসে বলেছেন পুকুরে সাত-সাতটি সোনার কলস আছে, তোরা তা নিয়ে নে! গায়েবি-আওয়াজ শুনে ভয়ে না না করতে-করতে ঘুম তার ভেঙে যায়। কিন্তু এখন-তো সকাল। ভয়ের কারণ নাই। তবুও ভয় তাকে জড়িয়ে থাকে। ছহিফা বিবির মুখ ম্লান থাকে সারাদিন। রাতের বেলা আবার ‘তিনি’ পুকুরের জল ছেড়ে খোয়াবে এসে দেখা দেন। এবার খোয়াব আসে ছহিফা বিবির ঘুমে-তোদের মালপত্র তোরা নিয়ে নে! ছহিফা বিবি না না করলে কী হবে, গায়েবি-আওয়াজ কিছুতেই থামে না, আরো দীর্ঘ হয়-তোর পেটে যে-পরিকন্যা আছে, তারে তুই দিয়ে দে, সাত-সাতটি সোনার কলস মাটি ফুঁড়ে ঘরের মেঝেয় উঠে আসবে!
ছহিফা বিবি স্বপ্নে দেখলেন পরপর সাত রাত। প্রতিবারই না না করে গায়েবি আওয়াজ ফিরিয়ে দিলে পুকুর উত্তাল হয়ে ওঠে। সেই উত্তাল-জলে সাত-সাতটি সোনার কলসও কেউ-কেউ ভেসে উঠতে দেখে।
ছহিফা বিবির মাথা আবার আউলাজাউলা দেখায়। রাত হলেই ঝনঝন শব্দ তুলে আউন্দা-পুকুরের সাত-সাতটি কলস ঘরের মেঝের নিচে চলে আসে। মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। বিলপাড়ের পিরের পড়াপানি আর ছহিফা বিবির না না কলসগুলোকে পুকুরে ফিরে যেতে বাধ্য করে।
ছহিফা বিবির কোলে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান আসে।
কিন্তু বছর ঘুরতে-না-ঘুরতে কেরামত মিয়া এক সন্ধ্যায় রক্তবমি করতে-করতে মারা গেলে কালাপুর গ্রামের মানুষেরা শুধু দেওলা-পুকুরই নয়, দেওলা-বাড়ির আশপাশেই ঘেঁষতে চাইলো না আর।
-তোমরা তো রেবা বিদেশ গিয়া খালারে ভুলি লাইলায়। খেশকুটুম হকলেই ভুলি গেলা। আমার সব পেটর ধন ‘তাইন’ নিলাগি। ‘তাইন‘ যে আরবার ছাতানি শুরু করলা, তার কিতা অইবো, কও চাই?
আজমল আলীর ধ্যান তবু কাটে না। সে আতিপাতি করে। এতো দিন পর কেনো ‘তিনি’ আরবার খোয়াবে আসতে শুরু করলেন, এতো খোঁজাখুজির পরও সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। অনেক দিন পর দেশে ফিরে খালাকে এই দেখতে আসা। কিন্তু উঠানে বসিয়ে সেই যে খালা গল্প জুড়েছেন, তার যেন কোনো শেষ নাই। এই কান্না তো, এই আবার হাসিতে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। পুরো একটা জীবন যেন আজ এই বিকেল বেলার উঠানে নামিয়ে আনবেন-বুঝলে রে আজমল, ‘তাইন’র কথায় কান দিলাম না, সাত রাজার ধন হারাইলাম, কুলর ধনও হারাইলাম। বাইচ্যা থাকলে আইজ তোমরার লাখান অইতো, লন্ডন-টন্ডন যাইতো। আমার কিতা আর দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে অইতো নি, ক চাই?
-দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতায় কেনে, খালা? আমরা আছি না নি? কিন্তু ‘তাইন’ আইয়া স্বপ্নে এখন কিতা কইন?
ছহিফা বিবির গলার স্বর আরো নিচে নেমে এলে প্রশ্নের উত্তর শুনতে আজমল আলীকে কান এগিয়ে নিতে হয়। জীর্ণ বাড়ির মতোই ছহিফা বিবির জীর্ণ মুখে রহস্য ঘনায়-‘তাইন’ আরবার খোয়াবে আইছইন। আইয়া কইলা, কতো দিন আর তোমরার ধন আটকাইয়া রাখতাম! তুমি বুড়া অইছো, আমিও অইছি। ইবার আমারে বিদায় দেও, ১৫ গরুর শিন্নি করো। বুঝচছ রে আজমল, ‘তাইন’ কইছইন পুব-পাড়র জঙ্গল পরিস্কার করাইয়া ওখানেই শিন্নি করাইতাম। তুই আমার লগে আয় চাই!
ছহিফা বিবি পুকুরের দিকে হাঁটা দিলে তাকেও সঙ্গে যেতে হয়। আছর ওয়াক্ত প্রায় শেষ, মাগরিবের তেমন আর বাকি নাই, এ-সময় এসব নিয়ে কথা বললে অনিষ্ট হবে না। এমন কি পুকুরপাড়েও একবার ঘুরে-আসা যায়। পুকুরের পুবপাড়ে অকাল মৃত স্বামী-সন্তানদের কবরের পাশে এসে দাঁড়ালে শেষ বিকালের রোদ ছহিফা বিবির মুখে ম্লান আলো ছড়ায়-আমি আর কয় দিন বাচমু রে পুত!
আজমল মাথা নাড়ে।
-তাইলে আমি থাকতেই কিছু একটা করি লাও রে পুত। আমি আইজ মরমু কি কাইল মরমু! ‘তাইন’ যখন কইছইন, সিন্নি করি লাও। ‘তাইন’ রে বিদায় দেও, আমারেও বিদায় দেও।
ছহিফা বিবি হঠাৎ মৃত সন্তানদের কথা স্মরণ করে আহাজারি করে উঠলে আজমল আলীকে দিশাহীন দেখায়। বেঁচে থাকলে ওরাও আজ বিদেশ-টিদেশ যেতো-ছহিফা বিবিকে তখন কি আর ১৫ গরুর সিন্নি করতে দুয়ারে দুয়ারে হাঁটতে হতো? আত্মীয়-স্বজনের দয়ায় যেখানে বেঁচে থাকতে হয়, ১৫ গরুর সিন্নি করা সেখানে কি চাট্টিখানি কথা? আছে তো এই ভিটা। দেওলায় ধরলো তো বংশই ছারখার করে ছাড়লো। দেখো কী ভাগ্য, মেয়েটাও শেষে অকাল-বিধবা হয়ে ভিটায় এসে উঠলো, নইলে কি আর অভাব ছিলো? বাড়ি বিক্রি করেই সিন্নি দেওয়া যেতো। কিন্তু ‘তিনি’ তো এখন প্রতিরাতেই আসছেন-‘তাইন’ তো বড়ো ছাতাই লাইলা রে, পুত! হকলে মিইল্যা কুন্তা একটা করো। ‘তাইন’রে বিদায় দেও, আমারেও বিদায় দেও!
ছহিফা বিবির আহাজারি পুবের আউন্দা-পুকুরে গড়িয়ে নামতে থাকলে সাত-সাতটি সোনার কলস মধ্য-পুকুরে যেন ঘাই দিয়ে ওঠে। আজমল আলী বাড়ি ফেরার তাড়া দেয়।
মুজিব ইরম