–দৈত্য
–তাশরিক-ই-হাবিব
তোমাদের এই ঋণ কোনোদিন শোধ হবে না
না না না শোধ হবে না …
এই গুনগুন গানের রেশ আমার মাথার ভেতর খানিক পরপর বেজেই যাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠতেই সেই যে গানের কলিটা চুপিসারে কানের ভেতর বাজতে লাগল, এই রাতের বেলায় নিজের ঘরে আবছায়া আঁধারে ডুবে যেতে যেতে সেটার কবল থেকে আমার আর নিস্তার রইল না।
কাল সারাদিন ভয়াবহ ধকল গেছে। কদিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাব, সিলেটে। বেড়াতে নয়, বউ-বাচ্চাও সঙ্গে যাবে না। নিতান্তই ইউনিভার্সিটির কাজে, আর একাই এবার বেরুতে হবে। করোনার প্রকোপ এখন অনেকটাই কম। সংবাদপত্রের পাতায় চোখ বুলিয়েও এ নিয়ে কোনো লেখা পেলাম না। তবে ঘটনা হলো, মানুষ এখন করোনায় মারা না গেলেও আক্রান্ত হচ্ছে যথারীতি। তবে দুই বছর যাবত এ জুজুর সঙ্গে কোলাকুলি হয়েছে বলে এখন আর একে কেউ পাত্তা দেয় না। এর লক্ষণগুলো এখন বোধহয় মামুলি জ্বরের মতোই। এর চেয়ে বরং সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন ঢের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। সংবাদপত্র তো সেগুলোকে সামনে তেমন আনে না। যদি তেমনটা ঘটত, তবে মানুষ হয়ত প্রতিদিনের নানা কাজে বাইরের বের হবার ব্যাপারে কোণঠাসা হয়ে যেত। আমার মাথায় এ চিস্তা কেন এল! দুই বছরের বেশি সময় এই ঢাকা শহরের বাইরে পা দেবার ফুরসত মেলেনি বলেই বুঝি! যা হোক, আমি কিন্তু এসব করোনা টরোনা বা সড়ক দুর্ঘটনার ভয়ে কাবু হতে রাজি নই। মন থেকে চাইছিলাম, কোনো ছুতোনাতায় সংসারের চৌহদ্দি আর এই ভয়ানক ব্যস্ত ঢাকা শহরের একঘেয়ে দিনযাপন থেকে খানিকটা সরে যেতে। সবে বইমেলার পুরো এক মাসের ধকল সামলেছি। এরপরই যে সিলেটের চাবাগানের হাতছানি কবুল করার সুযোগ এল, ভেবেই মনটা ভালো হয়ে গিযেছিল। সাদা খামে প্রিন্ট করা চিঠিটা এসেছে ওখানকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরীক্ষার কাজে আমাকে ডেকেছে। এদিকে ঘাড়ে জমে থাকা কাজগুলোও যে ঝটপট গুছিয়ে নেব, সেই সুযোগ আর হয়ে উঠছে না। এর মধ্যেও যেসব কাজ করা যায়, ঝটপট করে উঠতে উঠতেই সারাটা দিন আর রাতের ক্লান্তি মিলেমিশে আমাকে নাস্তানাবুদ করে ফেলল। বেঘোরে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম বিছানায় পিঠ ঠেকাতে না ঠেকাতেই! ফাগুনের রাতে বেশ হাওয়া খেলল, ফলে গরমের উৎপাত বা মশার ভনভনানি টের পাইনি। মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলাম ঘুমানোর আগে, ঢুলুঢুলু চোখে। জমে থাকা কাজগুলো করতে ঘুম ভেঙে উঠতে হবে ভোরে। মনের ভেতর চাপা উত্তেজনা। কতদিন পর, একা যাব, সিলেটে! মাথার ভেতর এ ব্যাপারটা সারাক্ষণই ঘুরপাক খাচ্ছিল। দুদিন আগে গিয়েছিলাম কমলাপুর রেলস্টেশনে, সিলেটের টিকেট কাটতে। সিলেট যাওয়া মানে তো এই ট্রেনযাত্রা! এর আগে দুবার সিলেট গেছি, সেই যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে। এরপর কেটে গেছে দুই যুগ! কী আশ্চর্য! সময় কীভাবে কেটে যায়!
তথ্য কেন্দ্রের রিসেপশনে বসা ফর্সা চেহারার লোকটির ঘন মোটা ভ্রুজোড়া, চকচকে টাক, হাফহাতা শার্টের কনুই থেকে বেরিয়ে আসা লোমশ হাতজোড়া আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে কেমন যেন সমীহ জাগে। যা জানতে চাই, তা গলা থেকে মুখ পেরিয়ে ঠোঁট বেয়ে কান পর্যন্ত পৌঁছল কি না, শুরুতে নিজের মনেই সন্দেহ জেগেছিল। ফলে নিজেকে প্রবোধ দিতেই যেন ঢোক গিলেও এবার গলা উঁচু না করে উপায় থাকে না। মোবাইলে বারবার চেষ্টা করেও কোনোভাবেই অনলাইনে টিকেট কাটার বন্দোবস্ত করা সম্ভব হয়নি বিধায় নিজেকেই হাজির হতে হয়েছে কমলাপুরে। কিছু একটা ঝামেলা যে ঘটেছে, তা অবশ্য আজ টের পেলাম, যখন কি না এই আখ্যানকাণ্ড লেখার তাগিদটুকু মন থেকে ক্রমশ ফুরিয়ে এসেছে, বিভীষিকাময় একটা সকাল পার করার পর! বাসায় ফিরে গোসল সেরে পেটে দানাপানি কিছু চালান দিয়ে যখন কি না ঘুমে ঢলে পড়বার জন্য পিঠটা সবে বিছানায় ঠেকিয়েছি বাইরের খা খা রোদের আঁচ থেকে বাঁচতে নিজের ঘরের জানালার পর্দা টেনে দিয়ে বেশ ছায়ামাখা আধোআধো ঘুমন্ত পরিবেশে নিজেকে সঁপে দিতে, তখন বালিশের পাশে পড়ে থাকা আজকের দৈনিকের শেষ পাতায় চোখ গেল।
চারকোণা একটি বিজ্ঞপ্তি, পাঁচ ইঞ্চি বাই তিন ইঞ্চি হবে। লাল রঙের বর্ডার, ভেতরটা অফ হোয়াইট। রেলওয়ের লোগোর নিচে ‘ট্রেনের টিকেট ইস্যু সংক্রান্ত গণবিজ্ঞপ্তি’। তার নিচে সবুজ রঙের আন্ডারলাইন। বিজ্ঞপ্তিতে লেখা হয়েছে, “এতদ্বারা সম্মানিত যাত্রী সাধারণের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, বাংলাদেশ রেলওয়র সকল আন্তঃনগর ট্রেনের টিকেট ২৫ মার্চ ২০২২ তারিখ ১৮:০০ ঘটিকা হতে কাউন্টারে কম্পিউটারের মাধ্যমে এবং ২৬ মার্চ ২০২২ তারিখ সকাল ০৮:০০ ঘটিকা হতে কাউন্টারের পাশাপাশি অনলাইনে বঃরপশবঃ.ৎধরষধিু.মড়া.নফ পোর্টালের মাধ্যমে ইস্যু করা হবে।”
গত কদিন নিজের কাজের চাপে আশেপাশে কী হচ্ছে না হচ্ছে, সেদিকে চোখ মেলে চাওয়ার ফুরসত ছিল না। ১৫ বছর পর রেলওয়ের টিকেট বিক্রির পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসছে। সেই পরিবর্তনের জেরে গত ২২ মার্চ থেকে অনলাইনে টিকেট বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে, কে জানত! আর আমি যদি তা আগেভাগে জানতামও, তাতেই বা এমন কি ব্যাপার হত! আমাকে তো আর রেলওয়ের দ্বারস্থ হতে হয় না! দেশের নাগরিক হিসেবে রেলওয়ের সেবাও শেষবার নিয়েছিলাম ২০১৮ সালে। কিশোরগঞ্জ থেকে ফেরার সেই অভিজ্ঞতা ছিল ভয়াবহ। এরপর আর কখনো লোকাল ট্রেনে সওয়ার হব না, কান মলেছিলাম। ভিড়ের মধ্যে মালসামান নিয়ে উঠতে গিয়ে বারবার লোকজনের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি তো হচ্ছিলই, এমনকি একেকবার মনে হচ্ছিল, ছোট কম্পার্টমেন্টের ভেতর দম আটকেই বুঝি মারা যাব! আরেকবার ভাবছিলাম, ভিড়ের ধাক্কায় যেভাবে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে দরজার দিকে এগুচ্ছি, তাতে ট্রেন থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। হায়রে, অগুণতি যাত্রীর হুল্লোড়ের মধ্যে কার মাথা কে খায়! কারো কথা কেউ শোনে না। অথচ সবাই নিজ নিজ গলা ফাটাতে মরীয়া! ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে সেবার রাতের বেলা সেই ট্রেনযাত্রার বিভীষিকা মনের ভেতর এতদিন পর আবার হানা দিচ্ছিল। কাজেই পাক্কা চার বছর পার করে ট্রেনের টিকেট কেনাবেচার রদবদল নিয়ে আমার উদ্বিগ্ন হবার কোনো কারণ তো ছিল না!
২৩ তারিখ বিকেলের দিকে বিভাগের লকার খুলে সাদা খামটা যখন পেলাম, তখন মনটা আনন্দে নেচে উঠল। ঢাকার বাইরে যাবার এই সুখবরটা পেতেই মনের ভেতর আনন্দের বান ডাকল। মনে হলো, করোনাকালের অভিশপ্ত দুনিয়া থেকে আমি যেন অপার্থিবলোকের দিকে রওনা দেবার জন্য এখনই মুখিয়ে আছি। যদি কেউ বলে, তুমি এখনই রওনা হয়ে যাও, আমি তখনই পা বাড়িয়ে দেব! মনের ভেতর একটা প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পেলাম। একবার অবশ্য সন্দেহ হলো, সত্যিই ওরা আমাকে ডেকেছে কি না ! হ্যা, খামের ওপর এই তো আমার নামধাম, ঠিকানা, কবে এ কাজের জন্য আমাকে আসতে হবে সবই লেখা আছে। কাজেই মোবাইলে ঝটপট রেলওয়ের ওয়েবসাইটে ঢুকে পড়লাম, সোফায় পিঠ এলিয়ে। কিন্তু এ কি! সার্ভার যে বন্ধ! কিছুতেই তো কাজ হচ্ছে না! সিলেট যাব, কাজেই ট্রেনেই যেতে হবে। অবশ্য আমার হাতে এখনো অনেক সময় আছে। এক সপ্তাহ পর যেতে হবে। বিভাগ থেকে ডিউটি লিভ নিতে হবে। হাতে জমে থাকা কাজগুলো শেষ করতে হবে। যতটা সম্ভব ঝামেলামুক্ত থাকা যায়! ডিউটি লিভের অনুমোদন না পেয়ে তো আর টিকেট কাটা সম্ভব নয়! একবার মনে হলো, এখানে বসে না থেকে বরং কমলাপুরে চলে যাই। পরে আবার সেই ভাবনা বাতিল করলাম। না, কোনো দরকার নেই। ট্রেনের শিডিউলটা দেখে সুবিধাজনক মনে হলো কালনী এক্সপ্রেসটা। ওটা ৩০ তারিখ দুপুর তিনটায় ছাড়বে কমলাপুর থেকে। আন্তঃনগর ট্রেন যেহেতু, কাজেই টিকেটটা আগেভাগে করে রাখতে হবে। আর তারপর বাসায় ফিরে রাতের বেলা টিভিতে নিউজটা দেখে আমার রাতের ঘুম হারাম হবার দশা! কোনো কারণে যদি টিকেট পাওয়া না যায়! অবশ্য প্লেনেও যাওয়া যায়। বাসও আছে, বিকল্প ভরসা হিসেবে। কিন্তু মন কিছুতেই সায় দিল না। ট্রেনে চেপে যাওয়ার আনন্দ আমাকে বারবার রোমাঞ্চিত করতে লাগল। রিজার্ভ কম্পার্টমেন্টে হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে যাব, কতদিন পর নিজের মতো করে জার্নিটা করব! চাকরির কাজের চাপ, সংসারের বারো ঝামেলা, বাজার সদাই, হেঁশেলের আনাজপাতির খবর আর বউয়ের সঙ্গে এটা ওটা নিয়ে ঝকমারি, এসব থেকে পালানোর জন্যই তো এত ব্যস্ত হয়ে উঠেছি। আর সেটাই যদি মাটি হয়! তাছাড়া ওরা আমাকে ডেকেছে কাজের জন্য, সিরিয়াস না হলে আর কখনো কি ডাকবে! ওরা এর আগে আমাকে ডাকেনি। কাজেই রাতের ঘুমটা ভালো হলো না। টেনশন আমাকে বরাবর কাবু করে। বউকে এটুকু জানিয়ে রাখলাম, আগামী সপ্তাহে আমি সিলেটে যাচ্ছি। ননস্টিক ফ্রাইপ্যানের ফুটন্ত তেলে সে তখন চাক চাক করে কাটা হলুদ মরিচ লবণ মাখানো ডুমো ডুমো বেলুনগুলো একে একে ছাঁড়ছিল। তার হাতে কাঠের ছেনি, পরনের শাড়ি গাছকোমর করে বাঁধা, কপালের এদিকে সেদিকে এলোমেলো চুল আর ঘামের আভাস চোখেমুখে ফুটে ওঠা বিরক্তিকে যেন আরো প্রকটিত করছিল। কিন্তু এক ধরনের চমকও ছিল আমার বলা খবরটাতে, ওর জন্য। চারদিনের জন্য আমি এ সংসার থেকে ছুুটি নিচ্ছি। ফলে ছেলেমেয়েকে দেখাশোনা, বাজার সদাই, সংসার চালানোর জোয়াল ওর ঘাড়ে চেপে বসবে। কিন্তু এসব আমাদের কাছে নতুন কিছুু নয়। সে নিজে যেহেতু বড় পোস্টে আছে একটা বিদেশি অফিসে, কাজেই তাকেও মাঝেমধ্যে ঢাকার বাইরে যেতে হয়। তখন অবশ্য বাচ্চাদের নানা-নানীকে আগেভাগেই বাসায় এনে রাখা হয়। অন্তত দস্যি ছেলেমেয়েকে চোখে চোখে রাখা আর তাদের সঙ্গ উপভোগ দুটোই এ সুযোগে ঘটে যাবে।
আমি কাল বিভাগে গিয়ে ডিউটি লিভ নেব। তারপর কমলাপুরে গিয়ে টিকেটের বন্দোবস্ত করব। মোবাইলে কোনোভাবেই রেলের সার্ভারে ঢোকা যাচ্ছে না।
আমার কথার পিঠে রেবা মুখে কিছুই বলল না। কিন্তু ওর হাতে ধরে থাকা বেগুনের টুকরোগুলো তাঁতানো ফ্রাইপ্যানে যেভাবে ফুটন্ত তেলের মধ্যে ছ্যাতছ্যাত করছিল, তাতে আমার মনে হচ্ছিল সে-ই বুঝি আমার ওপর তোঁপ দাগছে। ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ধীরে। কাজের বুয়া গত মাসেই জানিয়ে দিয়েছিল, চলতি মা থেকে আর আসবে না। তার অসুখ বলে কাজ ছেড়ে দেবে। নতুন কাউকে এখনো পাওয়া যায়নি। ছুটা বুয়াকে দিয়ে কি আর বাঁধা বুয়ার কাজ চলে! কোনোমতে ঠেকা দিয়ে সংসার চালাতে হচ্ছে। আমি চারদিনের জন্য না থাকলে আর কিছু না হোক, ছেলে-মেয়ে যে ওর মেজাজ দফায় দফায় খারাপ করে ছাড়বে, এ তো আর নতুন করে বলার কিছু নেই। তবু আমি এ নিয়ে গা করলাম না। কেননা, সবকিছুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাই সংসারী মানুষের ধর্ম। দুমাস আগে রেবা ময়মনসিংহে গিয়েছিল পাঁচদিনের অফিসিয়াল ভিজিটে। তখন অবশ্য বুয়া ছিল। এখন বুয়া নেই। কী আর করা! আমার শ্বশুর-শাশুড়িকে আরেক দফা ধকল পোহাতে হবে! কুমিল্লা থেকে এখানে আবার আসতে হবে!
সেদিন রাতে ঘুম ভালো হয়নি। ডিউটি লিভ পাব কি না, এ নিয়ে টেনশন ছিল। আমি জানি, এ নিয়ে কেউ ঝামেলা করতে চাইলে করতে পারে। আবার নাও করতে পারে। এ নিয়ে ভেতরে ভেতরে বয়ে চলা টেনশন পুরনো অনেক কথাই মনে করিয়ে দিয়েছিল। সেসব আর এখন মনে করতে চাই না। ট্রেনের টিকেট পাওয়া না পাওয়ার ব্যাপারটা ধীরে ধীরে মাথায় চেপে বসছিল। রাতের বেলায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ¯^প্ন দেখলাম, জাতীয় পতাকা ঝোলানো একটা ট্রেন রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এসেছে। লোকজন এটাতে উঠে বসছে মালপত্র নিয়ে। লাইনম্যান পতাকা নাড়ছে, ট্রেন স্টেশন ছেড়ে চলে যাচ্ছে, বাঁশি বাজছে, আর আমি কি না তখনো প্ল্যাটফর্মেও গেট পেরিয়ে ট্রেনের ধারেকাছেও পৌঁছতে পারিনি! ট্রেনে চড়তে না পারার হতাশা আমার বিষণœ কাতর চোখে জল বইয়ে দিতে চাইছে! আমি পাথরের মতো ভোঁতা মুখ নিচু করে রেখেছি। ট্রেনের কুউ ঝিক ঝিক ঝিক ঝিক ঝি ক ঝি ক আওয়াজ আমার কানের ভেতর দিয়ে ঢুকে গেল, ছড়িয়ে গেল স্নায়ুতন্ত্রীতে, নিজেকে ভারী অসহায় ঠেকল। আশেপাশে উড়তে থাকা একরাশ কাকের কলরবে মনে হলো সেগুলো বুঝি আমাকে উপহাস করছে। বিরক্তিকর কা কা কা কা আওয়াজ ছুটন্ত ট্রেনের ঝক ঝকাঝক থেমে যাওয়ার পরও মাথার ওপর বিলাপ চালাতে থাকায় আমি ক্ষেপে গিয়ে হাতে ধরে থাকা ব্যাগ ছেড়ে একটা ঢিল কুড়িযে কাকগুলোর দিকে ছুঁড়বার জন্য এগুতেই ঘুম ভেঙে গেল। রাতের নির্জন আঁধারে বিছানায় নিজেকে ভারী একা মনে হলো। ছেলেমেয়েকে নিয়ে রেবা বেডরুমে থাকে। গরমে অতিষ্ট লাগে বলে আমি এখানেই শুই। মনে হলো, সিলেটে যাওয়ার ব্যাপারটি কোনো কারণে আমার মনের ভেতর একটা ওলটপালোট ঘটিয়ে দিচ্ছে। বহুদিন নিজেকে, শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবার অবকাশ হয়নি। বছরের পর বছর এই একই শহরে দিনযাপন করতে করতে ভেতরে ভেতরে যে গুমরে মরছি, সেই বোধ এতদিনে জাগল, মাঝরাতে দুঃস্বপ্নের তাড়ায় ঘুম ভেঙে যাবার পর! নিজের জন্য, শুধু নিজের জন্য খানিকটা সময় দেবার ফুরসত জীবন থেকে যে হারিয়ে গিযেছিল, এতদিনে তা বুঝি টের পেলাম! মোবাইলে রাত আড়াইটা। অ্যালার্ম তো বাজেনি! তবে যে ঘুম ভাঙল! তলপেটে চাপ বোধ করলাম। সকাল সকাল অফিসে যেতে হবে ডিউটি লিভের বন্দোবস্ত করে সোজা কমলাপুরে। কবে থেকে টিকেট দেবে, সেই বিজ্ঞপ্তি না জানালে ভোগান্তি বাড়বে বই কমবে না।
শাহনাজ রহমতউল্লার গলায় গাওয়া গানের বাণী মনকে বেশ নাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না, গানটি কেন একনাগাড়ে অবিরাম বেজেই চরছিল! ভোরে ঘুম ভাঙল এই গান কানে ঢুকতেই। তখন অন্ধকার আকাশ সবে লালচে বরণ মেলতে শুরু করেছে। এত সকালে আমার ঘুম সাধারণত ভাঙে না। কিন্তু কেন যেন আমার ঘুম ভেঙে গেল। বোধহয় গরম লাগছিল। রুমের সিলিং ফ্যানের স্পিড কমে গিয়েছিল, রেগুলেটরের ঝামেলার কারণে। রেগুলেটর বদলানোর কথা বারবার মনে হয়, গরমে ভুগতে থাকলে। তারপর আবার যেই কি সেই! কিন্তু কানের ভেতর তখন সেই গানটা একটানা বেজে চলছিল। মাথা বোধহয় অসাড় হয়ে গিয়েছিল। এক মনে গানটা শুনতে শুনতে কখন আবার ঘুমে চোখ লেগে এল, খেয়াল ছিল না। কিন্তু এটুকু বুঝেছিলাম, এখনো সকাল হয়নি। আর তাই এখনই ঘুম থেকে ওঠার কোনো দরকার নেই। আরো তিন ঘণ্টা আরামসে ঘুমানো যাবে।
যেই লোকটাকে ২৪ তারিখে দেখলাম তথ্যকেন্দ্রের রিসেপশনে বসে থাকতে, তার কাছ থেকেই জানা গেল যে ৩০ তারিখের টিকেট এখানকার কাউন্টার থেকে বিক্রি শুরু হবে ২৬ তারিখ সকাল আটটা থেকে। একবার ভাবলাম, তাকে বলি, কেন টিকেট বিক্রি ২৪ ও ২৫ তারিখে বন্ধ থাকবে? অনলাইনে টিকেট বিক্রি চালু থাকলে তো পাবলিকের এত ঝামেলায় পড়তে হয় না! আর কাউন্টারের সামনে এই যে গাদা গাদা লোকের দঙ্গল, সেজন্যই তো ছোটবেলায় বাংলা ক্লাসে পড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার সেই যে ‘তিল ঠাঁই আর নাহি রে’ লাইনটা এতদিন পর মনে পড়ল! ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে সবকিছু! জগাখিচুড়ি পাকাচ্ছে যেন গত কদিনের ঘটনাগুলো! এত সকালে আমি ঘুম থেকে খুব কম উঠি। যেহেতু লোকটা বলেছিল ২৬ তারিখ সকাল আটটায় টিকেট বিক্রি শুরু হবে কাউন্টার থেকে, তাই মনে শঙ্কার তো ছিলই! সাধের ট্রেনযাত্রার সুযোগ কি হাতের নাগালে এসেও উড়ে যাবে! তীরে এসে তরী ডুববে! না, কিছুতেই তা হতে পারে না। আমার একটা ট্রেনযাত্রার বড্ড দরকার ছিল। এটা শুধু নিজের জন্য নয়, আমার চারপাশের মানুষগুলোর জন্যও দরকার। নইলে আমি যে ভেতরে অবিরাম ক্ষয়ে যাচ্ছি, তা কিছুতেই রোধ করা যাবে না। শরীরের ক্ষয়-জরার কবলে বন্দী হলে ধরা পড়ে। কিন্তু শ্রান্তি ও বিষাদ, শরীরের ওপর বয়ে চলা ধকলের জের মনের দফারফা ঘটিয়ে দেয় চোরাপথে। তা রোধ করার উপায় কী? নিজেকে সময় দেয়া, চাঙ্গা হয়ে ওঠা, নিজের আনন্দটুকু খুঁজে পাওয়া! ছেলে-মেয়ের জন্মের পর থেকে স্বামীর পরিচয়ের পাশাপাশি বাবার দায়িত্বের শৃঙ্খলে আটকে গেছি। স্বামী হিসেবে রেবাকে কতটা আপন করতে পেরেছি, তা প্রমাণিত হয়েছে ছেলেমেয়ের আসার পর। এ নিয়ে ঘটা করে মন খারাপ করার কিছুু নেই তো! কারণ মধ্যবিত্ত সমাজে এটিই চেনা বাস্তবতা। সেকারণেই এবার নিজেকে ফিরে পেতে আমি কোনো ঝুঁকি নিতে চাইনি। রেবা ও বাচ্চারা আমার সঙ্গে থাকলে খুব ভালো হত। তা হবার জো নেই। ওদের স্কুল আছে। রেবার অফিস আছে। করোনাকালে বাসা থেকে বের হওয়ার ব্যাপারটি ক্রমশ অসম্ভবের পাল্লায় পড়েছে। আমাদের বুস্টার ডোজ দেয়া বাকি। ছেলেমেয়েকে কোনো টিকাই দেয়া হয়নি। কাজেই খাঁচায় ছোলা দেয়া পোষা পাখির মতোই ওরাও এতদিন বাসায় বন্দী থেকে দিন পার করল। সবাই ভুগেছি করোনায়। এসব কারণেই আর বেড়ানোর ব্যাপারটা আমাদের সামনে আসেনি। অবশ্য এখন ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে। ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যেতে আসতে হয়। সে ক্লাস ওয়ানে পড়ে। মেয়েকে কিন্ডারগার্টেনে দেব, রোজার ঈদের পর। আপাতত নিজের কাজগুলো সামলে ওঠার পায়তারা চলছে। কাজেই সিলেট সফর কোনো আহ্লাদের বিণয় নয়। এটা আমার অফিসিয়াল কাজ, যা ঠিকঠাক পালন করার ওপর অনেককিছুই নির্ভর করছে। তবে মনের প্রফুল্লতা ফিরিয়ে আনাটাও যে এ কাজের অংশ, বুঝতে পেরেছি বলেই ট্রেনের টিকেট পাওয়া না পাওয়া বিষয়ক টেনশন আমাকে খানিকটা বিভ্রান্ত করেছে। দুঃস্বপ্নটা কি সত্যি হবে নাকি! মনে হয় না। কারণ আমি তা কোনোভাবেই হতে দিতে পারি না। সেকারণেই মোবাইলে দিয়ে রাখা অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম ভাঙবে কি না, আমি ঘুমের ঘোরে পুরনো অভ্যাস হিসেবে সেটা বন্ধ করে আবার ঘুমিয়ে যাব কি না, এসব ছোটখাটো তুচ্ছ বিষয়ও আমাকে ভাবিয়েছে। অস্বীকার করার জো নেই, এসব কারণেও রাতের ঘুমটা তেমন সুবিধার হয়নি। যা হোক, ঘুম যখন একবার ভেঙেছে, এখন আর শোবো না। তাহলে আর উঠতে পারব না। এ কি! মোবাইলে সবে ভোর ছয়টা চার! এখনো অনেক সময় আছে। হাই তুলতে তুলতে আবার বালিশে মাথা গুঁজে পিঠ ঠেকালাম বিছানায়। অমনি সেই গান কানের ভেতর ধীরে ধীরে বাজতে শুনলাম। অমনি তড়াক করে উঠে বসতেই গান হাওয়া হয়ে গেল। শাহনাজ রহমতউল্লাহের ডাকে সাড়া দিতেই যেন তখন আবছা অন্ধকার আকাশ লাল টিপের আভাস ছড়িয়ে ধীরে ধীরে ফিকে রঙের জালে আবিরগোলা ছড়াতে লাগল। আতংক তখনই আমাকে পেয়ে বসল। এবার বুঝতে পারলাম, ব্যাপারটি কী! আমাকে তো লাইনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে! এরই মধে ছয়টা বেজে গেছে! আটটার দিকে ঘড়ির কাঁটা ছুটছে। আর আমি কি না এখনো বিছানায় আছি! ট্রেনের টিকেট পাওয়া না পাওয়ার ওপর আমার স্বপ্নটি বাস্তবায়িত হওয়া না হওযার ব্যাপারটি নির্ভর করছে। সেই ভয়ে ঝটপট পিঠটান দিলাম বিছানা থেকে। আলসেমিতে কিছুুতেই বিছানা ছাড়তে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু কিছু পেতে হলে কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। কাজেই ঘুমের মায়া ছেড়ে আমি জোর করেই সটান উঠে পড়লাম। হাতমুখ ধুঁয়ে ফ্রেশ হয়ে জামাকাপড় আয়রন করে পেটেমুখে কিছু গুঁজে বেরুতে বেরুতে ঘড়ির কাঁটা সাতটা পেরিয়ে গেল। লিফটে ঝটপট নিচে নেমে গেট খুলে বেরিয়ে গেলাম। সিএনজি পাব কি না ভাবতে ভাবতেই রাস্তার ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। অমনি কানের ভেতর আবার শাহনাজ রহমতউল্লাহর বিষণ্ন বিলাপমাখা কাতর গলা বেজে উঠল। এবার আর গানটাকে সহজভাবে নিতে পারলাম না। মেজাজ ধীরে ধীরে গরম হয়ে উঠল। রিকশা তো পেতেই হবে! নয়ত এখন কমলাপুরে যাব কীভাবে! স্বাধীনতা দিবসের রাষ্ট্রীয় ছুটির আমেজে রাজধানীবাসী এখনো তেমন জেগে ওঠেনি। ঘুমের পরশে সুখযাপনের পালা শুধু আমারই কপালে নেই! কে জানত, ট্রেনের টিকেট পাওয়া নিয়ে এই গ্যাঁড়াকলে পড়তে হবে! ভালো লাগে না ছাই এই হাঙ্গামা! ক্ষিপ্র চোখে এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে পেছন থেকে হেলে দুলে এগিয়ে আসতে থাকা এক রিকশাচালককে ডাকলাম। কিন্তু তার ভাবগতিক দেখে তেমন সুবিধার ঠেকছিল না। বয়স্ক লোক, চুল দাড়ি পাকা, কপালের সামনের দিক থেকে চুল উঠে গেছে, গায়েগতরে তেমন বল নেই। হ্যাংলা পাতলা গড়ন, কিন্তু জোরকদমে প্যাডেল মারার লক্ষণ নেই। তবু বাধ্য হয়ে তার সঙ্গে কথা চালাতে হয়। তাতে অন্তত গান শোনার ব্যাপারটা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়া যাবে।
যাবেন, কমলাপুরে? রেলস্টেশনে।
রিকশাওয়ালা কী যেন ভাবে। আশেপাশে আর কোনো রিকশার দেখা নেই। কাজেই প্যাসেঞ্জারের কাছে কম ভাড়া কেন চাইবে সে! মুখ যখন খুলতেই হবে, বেশি ভাড়াই চাওয়া যাক, এমন ভাবগতিকই ঠেকছিল তার চোখেমুখে। কিন্তু আমি তো তাকে বেশি টাকা দেব না! কারণ সে তো দ্রুত চালাতে পারবে না!
একশ বিশ ট্যাকা দেবেন!
না। যাও।
কত দিবেন?
আশি টাকা।
টিএসসির মোড়েত্তন কমলাপুরে আশি ট্যাকা! জিনিসপাতির বাজারে আগুন আর আপনেরা আছেন খালি নিজেগো পকেট ভারী করা নিয়া!
অ্যাই, বেশি কথা বলবে না। একদম চুপ। যাও, ভাগো। তোমার কমলাপুরে যেতে হবে না।
সকালবেলাই যাত্রা অশুভ! এই রিকশাওয়ালার সঙ্গে কথা বলাটাই ঠিক হয়নি। মনে মনে গজগজ করতে থাকলাম। সে অন্য প্যাসেঞ্জারের ডাকে সেদিকে এগিয়ে যাবার সময় আমার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকাল। আমি দেখেও দেখলাম না। কী দরকার তাকে পাত্তা দেবার! সেই গান যে এতক্ষণ থেমে ছিল আর এখন আবার বাজতে শুরু করল, তাতে মনে হলো মাথার ভেতর বুঝি শট সার্কিট হয়েছে। নইলে এই একই গান মাথার ভেতর দিন রাত বাজতে থাকবে কেন?
অ্যাই, রিকশা, এদিকে, এদিকে।
বেশ দূর থেকে এগিয়ে আসা রিকশার হ্যান্ডেলে লাল সবুজ পতাকা পতপত করে উড়ছে। এই রিকশাওয়ালা হাসিখুশি স্বভাবের। একশ টাকা ভাড়া চেয়ে শেষে নব্বই টাকায় রাজি হলো। ঝটপট উঠে বসলাম রিকশায়। শান্তি! মনে হলো পতাকায় লেপ্টে থাকা বাতাস আমার বিক্ষিপ্ত মনকে পরশ বুলিয়ে দিল। ঝটপট যেতে হবে। আটটা থেকে ট্রেনের টিকেট বিতরণ শুরু হলে এতক্ষণে তো কাউন্টারের সামনে বিশাল বড় লাইন দাঁড়িয়ে গেছে! অমনি চোখের সামনে ভেসে উঠল দুদিন আগে দেখা দৃশ্যটা।
খা খা রোদের কবলে পুড়ছে শহরটা। দমকা বাতাসের তোড়ে রাস্তার ওপর থেকে ধুলো উড়ে আসছে চোখেমুখে। বৃষ্টির মৌসুম এখনো শুরু হয়নি। টানা কয়েক মাস বৃষ্টিহীন বলে ধুলোর উৎপাতে তিষ্টানো দায়! থুতনির নিচে ঝুলিয়ে রাখা মাস্কটা আবার টেনে নিলাম নাকমুখ ঢাকতে। এদিকে এত ধুলো জমে আছে যে বাতাসের তোড়ে চারদিকে যেন ধোঁয়াশার রাজ্য। রিকশাভাড়া মিটিয়ে চটজলদি ছুটে গেলাম কাউন্টারের দিকে। চারদিকে লোকজনের ভিড় তো নয়, যেন জনসমুদ্র। এপাশ থেকে ওপাশে গিজগিজ করছে অসংখ্য মাথা। মানুষের মাথা মানুষে খায়, এ অবস্থাকেই বোধহয় বলে! আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। মানুষের ভিড়ে তো টিকেট কাউন্টারই গায়েব হবার জোগাড়! কাউন্টারের ওপরের দিকে হোল্ডিংয়ে যদি প্রয়োজনীয় তথ্যাদি লেখা না থাকত, তবে তো বিভ্রান্তিতে পড়তাম! যা হোক, যেহেতু আমার গন্তব্য আপাতত তথ্য কেন্দ্র, ভিড়ের পাশ দিয়ে সেদিকেই এগুতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু কাজটা সহজ নয়। কারণ কাউন্টারের সামনের বিশাল চত্বর পেরিয়ে দুই ধাপের সিঁড়ি নেমে যাওয়া রাস্তার ওদিকটাতেও বিশাল বড় লাইন পরেছে। সেই লাইনের শেষ কোথায়, দেখার সাহস হলো না। আমার মাথায় তখন একটাই চিন্তা খেলে যাচ্ছে। ৩০ তারিখ দুপুর তিনটার ট্রেনের টিকেট কবে থেকে পাওয়া যাবে! কাজেই অন্যদিকে মনোযোগ না দিয়ে সোজা ঢুকে গেলাম তথ্যকেন্দ্রের রিসেপশনে। করোনার সংক্রমণ চলায় গেটের সামনে একটুরো কাপড় হয়ত পাঁচ হাতের মতো হবে, এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত লটকানো। ফলে আমার মতো যারা কোনো বিষয়ে জানতে এখানে আসে, তাদেরকেও হুটহাট ভেতরে না ঢোকার ইঙ্গিত এতে থাকে। কিন্তু আমার তখন মাথা গরম, আর এখানে না ঢুকে অন্য উপায়ও নেই। কাজেই অন্যদের পাশ কাটিয়ে আমি ভেতরে গিয়ে নিজের পেশাদার পরিচয়টাই শুরুতে দিলাম। জানি, এতে কাজ হবে। কেননা, দশজনের ভিড়ে একজন যদি আলাদা ধরনের হয়, তার দিকেই আগে লোকের নজর যাবে। আমার মাথায় তখন আর চারপাশের ভয়াবহ ভিড়ের ব্যাপারটা ছিল না। যেহেতু একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল, সেহেতু অন্যদিকে মনোযোগ আর ধাবিত হয়নি। কিন্তু বাসায় ফেরার পর টের পেয়েছিলাম, টেনশন আমাকে পেয়ে বসেছে। কারণ মোবাইলে বারবার চেষ্টা করেও অনলাইন বুকিংয়ের বন্দোবস্ত করা সম্ভব হয়নি। ফলে ২৪ তারিখ থেকে এই ২৬ তারিখের স্বাধীনতা দিবসের ভোরবেলা অবধি টেনশন থেকে আমার নিষ্কৃতি মেলেনি। নানা কাজের মধ্যেও ঘুরে ফিরে একটাই চিন্তা ভর করছিল। ট্রেনের টিকেট পাব তো!
রিকশা এগিয়ে চলেছে দোয়েল চত্বরের ওদিক দিয়ে। স্টেডিয়াম মার্কেটের গেট এখন খোলা থাকার কথা। রিকশাওয়ালা সেদিক দিয়েই ঢুকল। তারপর এদিকের রাস্তা ওদিকের গলি সেদিকের ফুটপাত ঘেঁষে যখন কমলাপুর রেলস্টেশনের সামনে এসে দাঁড়াল, তখন মোবাইলে সাতটা তেত্রিশ। বারবার করে তাড়া দিচ্ছিলাম তাকে। বেশ পোক্ত চেহারার মাঝবয়সী লোকটা কিন্তু আমার তাড়াতেও বিরক্ত হচ্ছিল না। প্রায় খালি রাস্তায় রিকশা বেশ জোরে চলছিল। কাজেই একসময় শাপলা চত্বরের পাশ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বিল্ডিং পেরিয়ে সোজা রাস্তা ধরে রিকশা এগিয়ে চলল। এদিকের রাস্তাঘাট আমার তেমন চেনা নয়। ফলে রিকশাওয়ালার ওপর ভরসা না করে আর যেহেতু উপায় নেই, সেহেতু বাকি পথটা চুপচাপই থাকলাম। গানটা যে মাথা থেকে নেমেছে, মনে হতেই স্বস্তি হলাম। আর বেশি পথ বাকি নেই বোধহয়। একসময় রেলস্টেশনের বাউন্ডারি দেয়ালের পেছনের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে টার্মিনালে গোলাকার বিশাল স্তম্ভগুলোর মাথা দেখা গেল। এদিকে লোকজনের চলাচল বেশ বেড়েছে। আবাসিক এলাকা ধারেকাছেই, কাজেই মানুষকে তো ঘর থেকে বেরুতেই হয়! ধীরে ধীরে রিকশা এগিয়ে চলল সিএনজি, মোটর সাইকেল বাস ট্রাক আর পায়েহাঁটা লোকজনকে যথাসম্ভব এড়িয়ে। যেখানে সারি সারি রিকশা নিয়ে চালকেরা দাঁড়িয়ে আছে যাত্রী তোলার জন্য, সেখানে সাবধানে গতি কমিয়ে থামল রিকশাচালক। রিকশাওয়ালাকে ছেড়ে দিলাম বাড়তি বিশ টাকাসমেত ভাড়া মিটিয়ে। তারপর শুরু হল নতুন এক যাত্রা! স্বপ্ন পূরণ করতে হলে বাস্তবের পটভূমিতে নিজের পাদুখানায় ভর করে দাঁড়াতেই হবে।
২৪ তারিখের দেখা দৃশ্য এবার আমাকে যেন ছোবল দিল। এ কী অবস্থা! সকাল সবে সাতটা আটত্রিশ, এরই মধ্যে টিকেট কাউন্টারের সামনের বিশাল চত্বরের মাঝামাঝি লোকে লোকারণ্য! ১ থেকে ৫ পর্যন্ত পরপর দাঁড়িয়ে থাকা পাঁচটি কাউন্টারের আগে থাকা মৈত্রী এক্সপ্রেসের কাউন্টার বোধহয় বন্ধ। কারণ ওটার সামনে একজনও নেই। দেশের বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াতের জন্য সকল আন্তঃনগরের যে পাঁচটি কাউন্টারের বন্দোবস্ত আছে, এগুলোর মধ্যে প্রথম তিনটি দেশের শোভন চেয়ার, শোভন ও সুলভ ক্যাটাগরির নন এসি কোচ। কিন্তু এগুলোর কোনোটিতেই আমি যাব না। আমি যাব এসিযুক্ত বার্থ কোচে। ৪র্থ কাউন্টারটিই হচ্ছে আমার সেই ইচ্ছাপূরণের স্বপ্নলোক! কতদিন শুধু নিজের মতো করে আমি একাকী এক অভিযাত্রিকের বেশে বেরিয়ে যাইনি এই ধুলোমাখা পৃথিবীর পথে-প্রান্তরে! রবীন্দ্রনাথের সেই যে ‘শাজাহান’ কবিতার লাইন মনের ভেতর গুনগুনিয়ে উঠল- ‘প্রিয়া তারে রাখিল না/ রাজ্য তারে ছেড়ে দিল পথ/ রুধিল না সমুদ্র পর্বত’। নিজেকে খানিকটা সময় দিতে চাওয়ার এ অসীম আকুলতা কি সব মানুষের ভেতরই থাকে! মানুষ কি আসলে বন্দী! সে কি কোনো এক সুযোগে মুক্তি খুঁজে পেতে চায়! জন্মের পর থেকেই কি তার স্বাধীন মনটি ক্রমাগত শেকলের পরতে পরতে জড়াতে জড়াতে বন্দী হতে শুরু করে! ঘর, সংসার, পরিবার, সমাজের ঘেরাটোপ কি তাকে অবিরাম কোণঠাসা করে! সংসার বড় মায়াময়, বিচিত্র প্রহেলিকার জালে মানুষকে বেঁধে রাখে। রক্তের সম্পর্ক, সামাজিক সম্পর্ক এসবকে তো অস্বীকার করা যায় না! কেননা সামাজিক মানুষ বলে আমি যে নিজেকে ভাবছি, সেই আমার এই আলো হাওয়া জলের দুনিয়ায় আগমনও তো সামাজিকতারই ফল! কিন্তু বন্দী মন যে তবু এই সহজ সত্যকে মানতে চায় না! বেশি কিছু চাওয়া তো নয়, শুধু দুটো দিনের দুবেলা ট্রেনযাত্রাটুকুতে নিজেকে, নিজের মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা গোপন ভুবনটিকে আবার খুঁজে পাওয়ার আকুলতা! এটুকুই তো আমার স্বপ্ন ছিল! এর বেশি কিছু নয়, এক তিল বেশি নয়! তবে যে আমার চারপাশে অগুণতি লোকের ভিড়, টিকেট কাউন্টারের ভেতর থেকে গম গম আওয়াজ ছড়ানো মাইকের চড়া গলার আওয়াজ কানের ভেতরে ঢুকে মানে বুঝে উঠতে না পারা সত্তেও অন্ধের মতো কিছু নির্দেশ মেনে চলার প্ররোচনা, যার যার প্রয়োজনকে সামনে রেখে ধরাবাধা নিয়মের রাস্তায় পথচলা, এসবের প্রয়োজন কী? প্রয়োজনের কি আর শেষ আছে! কেউ হয়ত দূরের শহরে যাবে অসুস্থ মায়ের কাছে, কেউ বা সোনার হরিণের চেয়েও মূল্যবান চাকরিতে যোগ দিতে তড়িঘড়ি বন্দোবস্ত করতে চায়, কেউ বা ইট কাঠ পাথর আর কংক্রিটের আবর্জনায় সয়লাব এই শহরে আর এক দণ্ডও তিষ্ঠোতে চায় না! সবুজ ঘাসের অনাবিল প্রান্তর যেখানে নীলচে আকাশের সঙ্গে মিতালি করেছে রূপালি নদীর বুকে জেগে ওঠা দুরন্ত ঢেউয়ের কোলে ঝলসানো সোনালি আভায় সেজে, সেখানে কারো মন বুঝি লটকে আছে! তাই তারও বড় তাড়া, একটা টিকেট যে কোনো ভাবেই হোক যোগাড়ের জন্য! আমার মতো আর কেউ কি আছে, যে ডুবসাঁতার কাটতে চায় শ্যাওলার আস্তরণ আর ঘোলা জলের সোঁদা ঘ্রাণের ভেতর, চুপিসারে সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে! বৃষ্টির ঘ্রাণমাখা হাওয়া বুক ভরে টেনে নিয়ে পরনের জামা খুলে কাদাজলে মাখামাখি হবার দুরন্ত উল্লাসে মেতে ওঠার অলৌকিক বিভোরতাকে সত্যি করতে আর কেউ কি আমার মতো ভেতরে ভেতরে অবিরাম ক্ষয়ে যাচ্ছে! কে জানে! সংসারের সদাইয়ের হিসাব, ভদ্রলোকের যাপিত জীবনে প্রয়োজনের শেকল বাঁধা হাজারটা ফাই ফরমাশ আর নানাজনের মনরক্ষার আয়োজন, এসবের বাইরে বেরিয়ে আসার ছুটি কে মঞ্জুর করবে? বউ? সে তো বলবে, ছেলের ক্রেয়ন লাগবে, মার্কেটে যাও। মেয়ে? সে তো বলবে, আমার জন্য বারবি ডল এনো। বন্ধু? সে তো নিজের কাজটা মনোহর হাসি আর প্রশংসার প্রলেপ মাখিয়ে উদ্ধারের চেষ্টায় ব্যস্ত! শেষ বিচারে নাকি জগত সংসারের কেউ আপন নয়! কে জানে, এই সংসারে কে আসলে আপন আর কে পর! প্রয়োজনের খাতিরেই নাকি বন্ধন গড়ে ওঠে! বন্ধন! একের সঙ্গে অন্যের সংযোগ! তবে কি বন্ধন মানে রেলগাড়ির বগিগুলো, একটার সঙ্গে আরেকটা জুড়ে দেয়া হয়, তারপর সমান্তরাল রেললাইনের ওপর দিয়ে দুই চাকায় ভর দিয়ে এগিয়ে চলে মানুষ! এই দুটো চাকা কি তার জীবন আর মরণ! ক্রস কানেকশন ঘটে না কখনো! অথবা কেউ যদি চকচকে ¯িøপারের ভেতর এঁটে থাকা কাঠের পাটাতনের ভেতর কোনোমতে পা পিছলে যায়! আর কোনোভাবেই যদি ভো বাঁশি বাজিয়ে রেললাইন কাঁপিয়ে কানে বিকট আওয়াজ তোলা বিশালকায় অজগরটি প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসতে আসতে তাকে কয়েক মুহূর্তেও মধ্যে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে হাড় গোড় মজ্জা চামড়া রক্তের নোনতা ঘ্রাণ চারপাশের হাওয়াহীন গুমোট দুপুরের খা খা রোদে জ্বলা দিগন্তের দিকে ছড়িযে দিয়ে চলে যায়! আর কিছু ভাবতে পারি না! চিন্তার ছেদ পড়ে রিসেপশনের লোকটির ডাকে।
আপনি তো নিজে না এসে অন্য কাউকে পাঠাতে পারতেন, স্যার!
লোকটি আমার পরিচয় মনে রেখেছে! কোনো প্রয়োজন তো ছিল না! আমাকে তিনি কেন এ সম্বোধন করছেন! আমি তো তার কাছে আর দশজনেরই একজন! বয়সেও তো তিনি আমার চেয়ে অন্তত বারো চৌদ্দ বছরের বড় হবেন!
আসলে, বাসাতে এমন কেউ নেই যে টিকেট আনতে পাঠাব। তাই নিজেরই আসতে হলো।
আচ্ছা। চার নম্বর কাউন্টারে গেলেই আপনি পাবেন।
আপনাদের অনলাইন সিস্টেমটা ঠিকমতো কাজ করলে অবশ্য আমি ওখান থেকেই টিকেট কাটতাম।
লোকটা আমার কথা কানে তোলার ফুরসত পেল না। আশপাশের চার-পাঁচজন কী নিয়ে যেন গলা চড়িয়েছে। তার চোখমুখে খানিক আগের শান্ত ভাবটা এখন মুছে গিয়ে বিরক্তি আর অধৈর্য ফুটে উঠছে। আমি সেখান থেকে বেরিয়ে আসি। কিছু করার নেই। বাস্তবতাকে মেনে নিতেই হবে।
চার নম্বর কাউন্টারের লাইনটা ইতোমধ্যে অর্ধবৃত্তাকার ভঙ্গিতে এগিয়েছে বিশাল চত্বরের মাঝের অনেকটা জায়গা জুড়ে। এর আশেপাশে আরো দুটো লাইন, দুই ও তিন নম্বর কাউন্টারের। আমি যখন লাইনে দাঁড়ালাম, তখন সামনে অন্তত একশ চল্লিশ-পঞ্চাশজন দাঁড়িয়ে আছে। মোবাইলে তখন আটটা বাজতে সতেরো মিনিট বাকি। করোনা বলে কোনো কিছুকে মানুষ বোধহয় আর পাত্তা দিতে রাজি নয়। আমিও তাদের দলে আছি। যেহেতু বাসার সবার করোনা হয়েছে দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণালে, গত বছরের জুনে, এরপর আমি দুই ডোজ টিকা নিয়েছি, তাই এ নিয়ে আর ভাবি না। বুস্টার ডোজ কবে দেবে, কে জানে! মাস্ক ইচ্ছা করেই পরিনি। যে যা বলে বলুক, ভাবে ভাবুক! লাইনে দাঁড়ানো কারো কারো মুখে অবশ্য মাস্ক আছে, কেউ বা থুতনির সঙ্গে মাস্কটি লেপ্টে রেখেছে, কেউ আবার মুখে মাস্ক এঁটে রাখলেও নাক যথারীতি খোলা। অবশ্য গাদাগাদি করা মানুষের ভিড়ে উষ্টা খেতে খেতে গরমে হাঁসফাঁস করে দম বন্ধ হবার ঝুঁকি তো আছেই! এজন্যই নিজেকে বেশ মুক্ত মনে হলো, মাস্কের হাঙ্গামায় যাইনি বলে।
তথ্য কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা তিনটি লাইনের কোনটি যে কোন কাউন্টারের, তা চটপট বুঝে ওঠা সম্ভব ছিল না। কারণ ডানে বামে বেশ কিছুটা খালি জায়গা তখনও ছিল। কিন্তু কোন কারণে কে জানে, প্রতিটি কাউন্টারের সামনে ভিড় করা লোকজনের নিয়ে গড়ে ওঠা লাইনগুলোর কোনোটাই সোজা নয়। ডানে বামে অর্ধবৃত্তাকারে একটার সঙ্গে অন্যটা এমনভাবে গা ছুঁয়ে আছে যে ভালোভাবে খেয়াল করলে এটাকে টিকেট কাউন্টারের লাইন মনে হবে না। যেন কোনো বিশেষ দিনের আয়োজনে প্যারেড গ্রাউন্ডে মহড়ায় অংশ নেয়া প্রশিক্ষণার্থীরা মিলেঝিলে কোনো প্রর্দশনীতে ব্যস্ত! যারা টিকেট কাটছে না, তারাও লাইনের আশেপাশে ভিড় করছে। অবশ্য এদের সংখ্যা তেমন নয়। কিন্তু আমি যেই বিভ্রান্তিতে পরলাম শুরুতে, অন্যরাও তেমন বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে কোন লাইনে দাঁড়াতে হবে বুঝে উঠতে না পেরে। আমি ধীর পায়ে এগিয়ে একদিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম, কোনটি চার নম্বর লাইন হতে পারে। তবু কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে সেই বরাবর লাইনের দিকে চেয়ে কোনো ফায়দা হলো না। ফলে তৃতীয় লাইনটির শেষ মাথায় দাঁড়ানো লোকটির কাছে পৌঁছতে আমাকে বেশ ঘুরপাক খেতে হলো সামনে পেছনে হেঁটে গিয়ে। তাতে দেখা গেল চার নম্বর কাউন্টারের টিকেট কাটার বুথটিতে পৌঁছতে হলে আমাকে অন্তত একশ দশ, একশ বিশ জনের অপেক্ষার পালা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু তাতেও আমি রাজি। কারণ যে কোনোভাবেই হোক, টিকেট আমার চাই। আর নিজের কাজ আমি সবসময় নিজেই করি। তাছাড়া যে কাজ শুরু করি, সেটি শেষ না করে আমি হাল ছাড়ি না। কাজেই লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। নিজের সিরিয়াল নম্বর কত, বোঝার উপায় নেই। আমার আগেরজন মাঝবয়সী এক লোক। খাটো মতো, দেখতেও শীর্ণ চেহারার, চোখজোড়া ছোটো ছোটো, মাথায় বেশ চুল আর নাকের নিচে যত্ন করে রাখা গোঁফ। পরনের পাঞ্জাবি রংজ্বলা। তবু তার সঙ্গেই এখন আমাকে খাতির জমাতে হলো। কিছু করার নেই। মানুষ পরিস্থিতির শিকার। কিন্তু এর মধ্যে থেকেও তাকে লক্ষ্য অর্জন করতে হয়। আমিও কবুল করেছি, নিজের ইচ্ছা পূরণের জন্য যতক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়, তাতে কোনো ছাড় নয়। একটাই ভয় এখন, চিকনগুনিয়ায় ২০১৭ সালে আক্রান্ত হবার পর বাম পায়ের গোড়ালির গিঁট ফুলে গিয়েছিল। ওখানে এখনো ব্যথা হয়। এটা নাকি পুরোপুরি সারে না। আমার পরিচিত কয়েকজন একথাই বলেছে। ডাক্তারের কাছে গিয়ে সাময়িক উপশমের ব্যবস্থা জেনে তা কদিন অনুসরণ করে হাল ছেড়ে দিয়েছি। এখন ব্যথা নেই। তবে একনাগাড়ে দাঁড়িয়ে থাকলে ব্যথা শুরু হয়। পায়ের ব্যথা বাড়ুক, যা হয় হোক, তবু লাইন থেকে বেরুচ্ছি না। টিকেট আমাকে পেতেই হবে।
সামনের লোকটির সঙ্গে আলাপ শুরু করলাম। তার আগে খেয়াল করলাম, আমার পেছনে একজন এসে দাঁড়িয়েছে।
ভাই, এইটা কি চার নম্বর কাউন্টারের লাইন?
কানের পাশে তার প্রশ্ন শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। বয়স পয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশের মতো। মাঝারি উচ্চতা, দাড়িওয়ালা, চোখে চশমা, স্বাস্থ্য ভালো, পরনের ইন করা শার্ট প্যান্ট বেল্ট ও পায়ের জুতো বেশ পরিপাটি। মাথার চুলগুলো পরিপাটি করে আঁচড়ানো।
হ্যা, এটা চার নম্বর কাউন্টারের লাইন।
লোকটি চারদিকে তাকিয়ে তার পেছনে আর কেউ আছে কি না দেখে দোনোমনা ভাব নিয়েই আমার পেছনে দাঁড়াল। আমি সামনের দিকে তাকিয়ে আমার আগেরজনের সঙ্গে আলাপ জুড়লাম।
আপনি কখন এসেছেন, ভাই? এই লাইন তো অনেক বড়! টিকেট কি পাওয়া যাবে?
আমার গলায় চাপা উদ্বেগ, যদিও তা আড়াল করতেই চাইছি।। কিন্তু এটি তো আমার একার ব্যাপার নয়, এখাতে ভিড় করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা আরো অনেকের হাল আমার মতোই!
আমি আসছি ভোরবেলা। সাড়ে ছয়টার মতো বাজে তহন। আইসা এইদিক হেইদিক ঘুরাঘুরি করলাম, খোঁজখবর নিলাম। আপনেরে একটু আগে দেখছি তথ্য কেনরে ঢুকতে। আপনের লাহান আমিও গেছিলাম হেইখানে। টিকেটের কি বিত্তান্ত, জানবার চাইচিলাম। হেরা কইল এই লাইনে খাড়াইতে।
আপনি আমার চেয়ে এক ঘণ্টা আগে এসেও এত বড় লাইনের পেছনে! তাহলে আপনার আগে যারা দাঁড়িয়ে আছেন, তারা কখন এসেছেন?
আমি বোকামি করছি। আমি আইয়া তথ্য কেনরে ঢুইকা দেরি কইরা ফালাইছি। নাইলে অহনে দশজনের আগে থাকবার পারতাম। ঐ যে, কালা জামা পরা লোকটারে দেখতাছেন, হের পিছনে আমার খাড়ানির কথা আছিল।
তার সামনের ঠিক এগার নম্বর আগের লোকটিকে দেখলাম। ওরে বাবা, এত বড় লাইন যে কতক্ষণে টিকেট পাবে, সে ভাবনা আমাকে আবার পেয়ে বসল।
আপনি কোথায় যাবেন?
দিনাজপুরে।
কবে যাবেন?
কালকা। আপনে?
আমি ৩০ তারিখে সিলেটে যাব। কালনী এক্সপ্রেসে।
কেডা আছে সিলটে? কুনো কামে যাইবেন? নাকি চা বাগানে ঘুরবেন ফিরবেন?
কাজ আছে।
এর বেশি আর মুখ খুললাম না।
আপনার বাড়ি কি দিনাজপুরে? সেখানেই থাকেন?
জে না। যাইতাছি বোনের বাড়িতে। হের পোলা অইব। ঢাকায় আমার বাসায় উঠব। মোহাম্মদপুরে থাকি। হের জামাইরে পুলিশে ধইরা নিছে। কেডা নাকি মিছা মামলা দিছে। অহনে পোয়াইত্যা বোইনেরে কেডা দেখব?
লোকটা নিজে থেকেই দুনিয়ার খবর জানাচ্ছে। আমি আর কথা বাড়াতে চাইলাম না। পেটের কথা বেশি বলতে নেই। কখন কে কোন বিপদ ঘটায়, বলা যায় না।
আপনে কি ঢাকাতেই থাহেন? বাসা কোথায়?
আমি মুখ খোলার আগেই সামনে থেকে বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা আসল আমার গায়ের ওপর। আটটা বেজে গেছে। টিকেট কাউন্টার খুলেছে। টিকেটকাটার টিকেট কাটতে শুরু করেছে। ফলে কাউন্টারের সামনে বেজায় ঠেলাঠেলি চলছে। আমার আগেরজন এসে আমার গায়ের ওপর পরল। আমি নিজেকে হুট করেই খানিকটা পেছনে দাঁড়ানো ঐ মাঝবয়সী ভদ্রলোকের গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পরতে পরতেও কোনোমতে সামলে উঠতে চেষ্টা করলাম। লাইনে দাঁড়ানো সবারই নজর টিকেট কাউন্টারের দিকে। সেখানে কী হচ্ছে, তা এত দূর থেকে স্পষ্ট বোঝার উপায় নেই। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে ৪ নম্বর কাইন্টারের দূরত্ব অন্তত একশ ফুট। এসময় আরেক কাণ্ড ঘটে গেল চোখের সামনে। এ কাউন্টারের লাইন আমার পেছনদিকে বাড়তে বাড়তে চত্বরের সিঁড়ির শেষদিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার পেছনে অন্তত পঁচিশ-ত্রিশজন এসে দাঁড়িয়েছে। সবারই চোখেমুখে চাপা বিরাগ ও অস্থিরতা। লাইন যত বড় হবে, ধৈর্যের পালা তত বাড়াতে হবে। কিন্তু সবাই চায় চটজলদি টিকেটটা পেয়ে যেতে। টেনশন তো নানা কারণেই হয়! মনে মনে কত ভয়ই যে উঁকি দেয়! শেষ পর্যন্ত আমি টিকেট পাব তো! আমি যেই টিকেট চাইছি, সেটাই পাব তো! নাকি অন্য কেউ আমার আগেই টিকেট কেটে নিয়ে যাবে! এর আগে তো টিকেট কাটার হাঙ্গামায় কখনো পরিনি! প্লেনের জন্য ট্র্যাভেল এজেন্সিকে ফোন দিলেই ডিলার বন্দোবস্ত করেছে। মোবাইল ফোনেই আনেক কাজ এগিয়েছে। ঢাকার বাইরে কাছাকাছি লোকেশন হলে নিজের গাড়িতেই গেছি। কিন্তু করোনার পর এবারই প্রথম বের হচ্ছি ঢাকার বাইরে। আর ট্রেনের জার্নিটাই আমার সবচেয়ে প্রিয়। সেকারণেই এ কাজের ব্যাপারে রাজি হয়ে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়কে জানিয়েছি। যে কোনোভাবেই হোক, আমাকে ট্রেনের টিকেট পেতে হবে। যদি লাইনে দাঁড়িয়ে না পাই, তখন! তখন কি কালোবাজারিদের কাছ থেকে বেশি দামে টিকেট কিনতে হবে! এছাড়া তো উপায় নেই! কী করব আমি? আমাকে এই দুর্নীতির সঙ্গে প্রয়োজনে জড়াতে হবে! আমি তো বাধ্য হব এটি করতে, টিকেট না পেলে! এতে আমার দোষ কোথায়! আমি তো আর সেধে ঐ পথে পা বাড়াতে চাইছি না! পুরো সিস্টেমের মধ্যেই যদি অস্বচ্ছতা আর ব্যবস্থাপনাহীনতা থাকে, এর দায় তো দেশের পাবলিক হিসেবে আমার ওপরও এসে পরে! আমি তো এর বাইরে গিয়ে টিকতে পারব না! কিন্তু এ নিয়ে এখনই বেশি ভেবে মাথা গরম করা ঠিক হবে না। আগে নিজের সিরিয়াল আসুক। দেখা যাক, টিকেট পাওয়া যায় কি না! একদিক থেকে আমার জন্য সুবিধা হয়েছে। যেহেতু পাঁচ দিন আগেই অগ্রিম টিকেট কাটার ব্যবস্থা আছে, তাই আমি অন্যদের চেয়ে এগিয়ে আছি। কোন ব্যাপারে? বেশির ভাগ যাত্রীই আগামীকালের টিকেট কাটবে, বিভিন্ন রুটের। কিন্তু আমি কাটব ৩০ তারিখের, ঠিক পাঁচ দিন পরের। ফলে অন্যদের চেয়ে আমার টেনশন এ কারণে কম। গায়ের ওপর ধাক্কাধাক্কির ঘটনায় চারপাশে প্রচণ্ড হট্টগোল শুরু হলো। একজন লাইন থেকে ছিটকে পড়ে গেছে মোজাইক করা মেঝের ওপর। ডান পায়ের পাতা বেকায়দায় চাপ খেয়েছে বোধহয়, এখন আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। একজন তার বগলের নিচে হাত ঢুকিয়ে আলগোছে দাঁড় করানোর চেষ্টা করতেই সে কাতরস্বরে আপত্তি জানাচ্ছে। কেউ কেউ আজেবাজে কথা বলছে টিকেটকাটার ও টিকেট পাবার এই ঝক্কির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের নিয়ে। গালাগালও শুরু হয়েছে, একের দেখাদেখি! ৪ নম্বর কাউন্টারের টিকেটকাটার খুবই ধীর গতিতে টিকেট কাটছে। সে বোধহয় কম্পিউটারের কী বোর্ড চালানোর কাজে নতুন। সেই তুলনায় ৩ আর ৫ নম্বর কাউন্টারের লোক দুজনের হাত ভালো চলছে। এ নিয়েও যাত্রীদের মধ্যে চলছে নানা কথাবার্তা। এসবের মধ্যেই হঠাৎ দেখি ২ নম্বরের লাইনটি, যেটি বিশাল অজগরের মতো ৪ নম্বর লাইনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চত্বরের সিঁড়ি পেরিয়ে আরো ছড়িয়ে যাচ্ছিল পেছনদিকের রাস্তায়, ১ নম্বর কাউন্টার খুলে দেয়ামাত্র সেই সাপের লেজের অর্ধেক যেন এক লাফে দৌড়ে গিয়ে ঐ কাউন্টারের সামনের জায়গা দখল করল। ফলে আরেকদফা ধাক্কাধাক্কি শুরু হলো। বিশেষত যারা ৩ নম্বর লাইনের শেষের দিকে ছিল, তারা ব্যাপারটি বুঝে ওঠার আগেই এ লাইনের মাঝামাঝি যাত্রীদের অনেকে ২ নম্বরে শিফট করল চটজলদি। আনসার ও পুলিশের দলের বাঁশির আওয়াজ, লোকজনের হট্টগোল, লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে হুল্লোড় ও গালাগাল – এসবের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমার মেজাজও চড়তে লাগল। নির্ধারিত সময়ে কাউন্টার খোলার কথা, কিন্তু কোনো কারণে ১ নম্বর কাউন্টার তখন খোলেনি। কী সেই কারণ, কে জানে! আশেপাশে কেউ বলছে, মাতারির পোলা টিকেটকাটার ডিউটিতে দেরি করে এসেছে, কেউ বলছে যে ডিউটি শিফট বদলের কারণে ঐ লোকের আসতে দেরি হয়েছে। আরেকজন মস্করা করল, শালা টয়লেটে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল হাগতে হাগতে! এরই মধ্যে গুজব ছড়াল যে কাউন্টারের পেছন থেকেও কাউকে কাউকে চুপিসারে টিকেট বিক্রি করা হচ্ছে! আর এ খবরটাই এবার এখানে সমবেত মানুষগুলোকে বেজায় রাগিয়ে দিল। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটটা পার হয়েছে! এক ঘণ্টা কখন ফুুরিয়ে গেল! এর মধ্যে আমি যে জায়গায় প্রথমবার দাঁড়িয়েছিলাম, সেখান থেকে মাত্র দশ ফুট এগিয়েছি। এর মধ্যে ৪ নম্বর কাউন্টারের মাত্র তিনজনকে টিকেট হাতে নিয়ে কাউন্টার ছাড়তে দেখেছি। আহা! তারা কত ভাগ্যবান! যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম এক নজর। সকাল আটটা থেকে মোবাইলে আবার অনলাইন টিকেট কেনার সুযোগ থাকার কথা। অনেকেই মোবাইল হাতে নিয়ে সেই চেষ্টা করছে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। কেন, কে জানে!
যাত্রীদের চোখমুখ থমথমে, বিষন্ন ও ভয়ংকর হয়ে উঠছে। কারণ টিকেট বিক্রির গতি চলছে ঢিমে তেতালে। একমাত্র ৫ নম্বর কাউন্টারের লোকটির ব্যাপারে কারো কোনো অভিযোগ শোনা যাচ্ছে না। অবশ্য এর কারণও আছে। সেই কাউন্টারে টিকেটের অগ্রিম বুকিং বাতিল করা, অগ্রিম টিকেট ফেরত নেয়া ও টিকেট ফেরত দেয়ার বন্দোবস্ত আছে। ফলে এর সামনে ভিড় সামান্যই। হাতে গোনা কয়েকজন সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে আমার মেজাজ এবার চড়তে থাকে। কারণ পিঠে ও কোমরে ব্যথা জোর জানান দিচ্ছে। ব্যথা শুরু একনাগাড়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে আমার এমনটা হয়। আমার আশেপাশের কেউ কেউ ইতোমধ্যে হাঁটু গেঁড়ে দুই পায়ের পাতায় ভর দিয়ে বসে পরেছে। কী করার আছে আমাদের? এত এত যাত্রীর টিকেট প্রয়োজন, অথচ অনলাইনে টিকেট বিক্রি বন্ধ করে রেখেছে ২২ তারিখ রাত থেকে। পাবলিকের কথা কে বুঝবে? তাদের ভোগান্তি আছে, ভোগান্তি থেকে বাঁচার উপায় নেই? এসব নিয়ে হল্লা শুরু হয়েছে। লোকজন যেন মারমুখী হয়ে উঠেছে। লাইনে দাঁড়ানো একজন এরই মধ্যে মোবাইলে কাকে যেন গালির তুবড়ি ছোটাচ্ছে। সেসব কথা কানে গেলেও কেউ যে তাকে খুব খারাপ ভাবছে, আশেপাশের লোকজনকে দেখে তা মনে হচ্ছে না। বেশ বুঝতে পারছি, পাবলিকের রাগ বলকাচ্ছে। তারা যদি পুলিশের দলকে পাত্তা না দিয়ে কাউন্টারে চড়াও হয়, তখন! কালবৈশাখীর গুমোট থম ধরে থেকে যখন সবকিছু তছনছ শুরু করে, তাকে কে রোখে! এখানেও যদি তেমন কিছু হয়! শেষে পুলিশ যদি চার্জ শুরু করে! টিকেট বিক্রি কি বন্ধ হয়ে যাবে! আমার সিলেটে যাওয়া! বাসে বা প্লেনে! না, এখনই এত কিছু ভাবতে চাই না।
খানকি মাগী পোলা, আমি আইষা লই, তরে তর বউয়ের সামনেই ভইরা দিমু। খাড়া, ট্রেনের টিকেটখান খালি পাইয়া লই। কাইল রাইতের থিকা এইহানে আইয়া রইছি টিকেটের লাইগা, তহন আমারে কস নাই ক্যান যে তিন দিন আগের অ্যাডভান্স টিকেট করন যায়! তাইলে কি আর আমি ঢাকায় অহন বইয়া বইয়া গুয়া মারি! আমি তাইলে তো বাসে কইরাই আইয়া পরি! … তর মায়েরে চুদি হাউয়ার পোলা … কীয়ের লাইগা … তর বাপে নি দিছিল হেই বন্দকী জমির টিয়া … তহন আমার কাছে হাত পাতছিলি ক্যা নটির পোলা! …
দেখছেন ভাই, এইহানের লোকজন কিরুম খারাপ! আমরা মশার কামড় খাইয়া গরমে মইরা রাত পার কইরা টিকেটের লাইগা রাতের ঘুম হারাম কইরা খালি প্যাটে অহনো লাইনে খাড়ায় আছি, আর কুত্তার বাচ্চারা কুন তাফালিং করে! আধা ঘণ্টা অইয়া গেল, পাঁচটা কাস্টুমাররে অহনো টিকেট দিবার পারে নাই। বেলেকে বেইচা দিতেছে সব! এইটা নিকি সিসটেম! বালের সিসটেম আমার!
কী করবেন, কন! হেগো সারবার নিহি কাম করে না! তাই কলম দিয়া হাতে লেখা টিকেট দিতাছে। হেই লাইগা টাইম লাগতাছে। দুই নাম্বার কাউনটারের লোকটা বড় খাচ্চর। হ্যায় আমগোরে গেরাহ্যিই করে না।
আরে ভাই, পাবলিকের দিকে তাকানোর সময় কার আছে? নাইলে আপনে চিন্তা করেন, চারটা দিন পার হয়ে গেল, তাদের কত ধরনের ঝামেলা, সেইসব মিটমাট না কইরা অহনো কি না টিকেট অনলাইনে ছাড়ার নামগন্ধ নাই। এই দ্যাখেন, সার্ভার কাজ করছে না। এই দেশটার নামই তো বাংলাদেশ, না? আর আইজ কি না দেশটার
স্বাধীনতা দিবস! এই দিনে আইসা পাবলিকের কত দিগদারি সওয়া লাগে!
আশপাশের লোকজনের এসব কথাবার্তা শুনেও শুনি না, চোখে দেখতেও ভালো লাগে না। এমন এক অবস্থার মধ্যে পরতে হবে, কে জানত! লাইন রীতিমতো শম্বুক গতিতে এগুচ্ছে! এ যন্ত্রণা কখন শেষ হবে, কে জানে! এর মধ্যে আরেক উপদ্রবের কথা কানে এল। পেছন থেকে কে একজন চেঁচিয়ে উঠল যে টিকেট নাকি ব্ল্যাকে আবার বিক্রি হচ্ছে। ভেতর থেকে কাদেরকে যেন কম দামে টিকেট দেয়া হচ্ছে। তারা আবার বাইরে বেশি দামে যাত্রীদের কাছে বিক্রি করছে। পুলিশ নাকি সব দেখেও দেখছে না! এই নিয়ে কারো কারো গলায় শোরগোল উঠল। কোনটা গুজব আর কোনটা আসল ঘটনা, এই গজবের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে তা মাথায় ঢোকানোর মুড আমার নেই। পাবলিক সমানে খ্যাকাতে শুরু করেছে। কাউন্টারগুলোর ভেতরে বসে টিকেট কাটতে থাকা লোকগুলোর প্রতি তারা রাগে এমনভাবে ফুঁসতে শুরু করল, যেন এখনই ছুটে গিয়ে তাদের ওপর চড়াও হবে! গ্রিলের সামনে কাচের পাল্লা থাকলেও পাবলিকের দাপটের সামনে সেগুলো যে তেমন লাগসই কিছু নয়, তা বেশ বুঝতে পারলাম। পেছন থেকে কারা যেন একসঙ্গে গলা তুলে শ্লোগান দেয়ার চেষ্টা করতেই রেল সার্জেন্ট বাঁশি ফুঁকতে শুরু করল। তাতে পাবলিক বুঝে গেল, বেশি কিছু করার সুযোগ এখানে নেই। আনসারের পোশাক গায়ে চাপানো দুজনকে দেখা গেল টিকেট কাউন্টারের দিকে কড়া চোখে চেয়ে থাকতে। পাঁচ নম্বর কাউন্টারের সামনে মনিটর থাকায় অনেকেই বলাবলি শুরু করল যে শুধু এই একজন টিকেটকাটার ঠিকমতো ডিউটি পালন করছে। পাবলিকের টাকায় যাদের বেতন হয়, তারা যে পাবলিককে কত খেল দেখাতে পারে, তার নমুনা দেখে লোকজন তেলে বেগুনে জ্বলছিল। ৫ নম্বর কাউন্টারে তেমন ভিড় নেই। এরই মধ্যে অবশ্য এ কাউন্টারের লাইনও লম্বা হতে শুরু করেছে। এক মহিলা বিলাপ করতে শুরু করেছে, তার অসুস্থ বাচ্চাকে আর বোধহয় প্রাণে বাঁচানো যাবে না! কী হয়েছে তার, সেদিকে কান পাতার গরজ আমার নেই। প্রায় দুই ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে এখানে আসার পর। এখন আমার মেজাজও খাট্টা হয়ে উঠেছে। বেশ বুঝতে পারছি, যারা নাওয়া খাওয়া ছেড়ে এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছে টিকেটের জন্য, তাদের সবারই কোনো না কোনো প্রয়োজন আছে, যা এই ভোগান্তি সত্ত্বেও না মিঠিয়ে উপায় নেই। সেকারণেই টিকেটের আশায় তারা অপেক্ষার প্রহর গুনছে।
আমার পেছনের জন একবার ফিসফিস করে কিছু একটা ব্যাপারে ইঙ্গিত দিল। ঘটনা কী, তা বোঝার তেমন গরজ আমার ছিল না। কেননা, সামনে এখনো একশ জনের বেশি একঠায় দাঁড়িয়ে আছে। সে দেখাল, আমাদের লাইন আর ৩ নম্বর লাইনের মধ্যে পেছন থেকে ময়লা জামা পরা একটা ছোকরা এসে হাজির হয়েছে। সে গুটি গুটি পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কাউন্টারের দিকেই যে সে যাচ্ছে, আর কোনো বিশেষ মতলব যে তার আছে, চোরা চাহনি আর মুখে কুলুপ এঁটে থাকার ভঙ্গি দেখে আমার ঘটনা বুঝতে দেরি হলো না।
দেখছেন, পেছন থেকে এসে লাইনে ঢোকার শখ! এই ছোকরা কিন্তু টিকেট কাউন্টারের দিকে গিয়ে ঠিকই কাউকে পটিয়ে পাটিয়ে নিজের টিকেট করিয়ে নেবে। এদেরকে পাত্তা দেয়া যাবে না।
আমি তার কথার জবাবে কিছু বললাম না। মানুষ মাত্রই ফিকিরবাজ। আমার যদি এইখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে টিকেট কাটার ভোগান্তি না থাকত, অন্য কোনো উপায়ে যদি টিকেট বগলদাবা করার সুযোগ থাকত, আমি কি তা করতাম না! আমার অবশ্য ঐ ছোকরার মতো অত সাহস নেই। সে হয়ত লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে টিকেট কাটার ধৈর্য ধারণ করতে পারেনি। হয়ত সে ভাবছে, কোনো উপায়ে টিকেট কাউন্টারের সামনে পৌঁছতে পারলে কোনো এক ফন্দি করে ঠিকই টিকেটটা কেটে নিতে পারবে! যা খুশি হয় হোক, আমি কিছুই বললাম না। এখন ইয়া নফসি ইয়া নফসি করাই ভালো।
আপনি খেয়াল রাখবেন, আপনার সামনে যেন লাইনের বাইরের কেউ আসতে না পারে। আমি খেয়াল রাখব, আমার সামনে যেন লাইনের বাইরের কেউ ঢোকার সুযোগ না পায়। তাহলেই হবে। পাবলিকের কত্ত শখ! সব আছে খালি নিজের ধান্দায়! আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা দুই ঠ্যাংয়ের উপরে বকের মতো খাড়ায় আছি টিকেটের জন্য, আর তারা কি না চামে চুমে লাইনের মধ্যে ঢুইকা টিকেট নেওয়ার ধান্দা করে! দ্যাখেন তো, হেই পোলা কী করে! আমি তো দেখতে পাই না!
আমি কিছু বলি না। মতলব এ জগতে কার নেই! আমার সামনে যারা আছে, তাদের কাউকে সে বাগাতে পারলে আমার কী করার আছে? জানি, এমনটা হওয়া উচিতও নয়। কিন্তু মানুষকে তো চেনা কঠিন! যারা আখের গোছাতে পারে, তারা এভাবেই লাইন থেকে বেরিয়ে আসার সাহস দেখাতে পারে। আমি তো তেমন নই! কাজেই আমি চুপ থাকি। তবে সেই ছেলেটির দিকে চোখ রাখি। সে পৌঁছে গেছে কাউন্টারের সামনে। আশেপাশের লাইনের লোকজনও এবার গলা চড়িয়েছে তাকে এখানে এভাবে আসতে দেখে। কিছু কথাবার্তা কানে এল। মনে হলো, একই কথা বারবার বলা হচ্ছে। সে কেন লাইন ভেঙে সামনে আসবে? সে অন্যদের মতোই সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে থাকবে। যখন তার সময় হবে, তখন যা বলার টিকেটকাটারকে বলবে। দুজন তো ধাক্কা দিয়ে তাকে পেছনে সরাতে নিজেদের লাইন ভেঙে বেরিয়ে গেল। কিন্তু সে তাদের গ্রাহ্যই করছে না।
অই মিয়া, অই, হাত ছাড়েন।
ক্যান? আপনে লাইন ভাইঙ্গা এইহানে আইয়া খাড়াইবেন কিয়ের লাইগা? আপনের সিলিয়াল যহন আইব, তহন সামনে আইয়া খাড়াইবেন।
আমার কথা আছে টিকেটকাটারের লগে।
কুনো কথা অহন নাই। টাইম অইলে আইবেন।
একজন তার জামার কলার চেপে ধরেছে। অন্যরা মারমুখী ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন ক্ষিপ্ত কুকুরের পাল, একটু পরই ঝাপ দেবে তার ওপর।
আমার হাত ছাড়েন কইলাম। নাইলে অহন একখান সিন ক্রিয়েট অইব।
অই শালা, তুমি শাউয়ার সিন ক্রিয়েট করবা? ইংলিশ চুদাও পাবলিক প্লেসে?
বাঁশির কর্কশ ফুঁ, হাতে থাকা রুলার, মাথায় ঝোলানো ক্যাপ, ইন করা বেগুনি শার্ট-প্যান্ট, কোমরে লটকানো চওড়া বেল্ট ও বুট জুতা সমেত দশাসই চেহারার লম্বা চওড়া লোকটি এগিয়ে আসাতে পাবলিকের নজর তার দিকে আকৃষ্ট হয়।
ঠিক যেন একটা দৈত্য! আমার আগেরজন ফোড়ন কাটে। ‘দৈত্য’ শব্দটা কানে যেতেই কেন যেন ‘দ্য সেলফিশ জায়ান্ট’ গল্পটা মনে পড়ে।
কে এইখানে ঝামেলা করছে? দেখি তার চাঁদবদনখানা?
এতক্ষণ হল্লা করা লোকজন সরে গেলে তার সামনে এগিয়ে আসার পথ পরিষ্কার হয়। যে দুজন মিলে এই ছেলেটিকে আটকেছিল, তাদের কাছে সার্জেন্ট এগিয়ে আসে।
কী হয়েছে, এখানে?
উৎসুক লোকজনের বহুকণ্ঠের বলকানিতে কথা স্পষ্ট কানে বাজে না। ফলে সার্জেন্টকে হাত উচিয়ে তাদেরকে থামাতে হয়।
ধীরে, ভাইসব, ধীরে। এত ব্যস্ত হবার কিছু নাই। সবারই টিকেট দরকার। এই টিকেটের জন্য আপনাদের মতো আমিও হাহাকার করতেছি। একজন বলেন, কী হয়েছে।
যে ছেলেটি পেছন থেকে হুট করে এগিয়ে এসে কৌশলে সবাইকে ডিঙিয়ে কাউন্টারের সামনে হাজির হয়েছিল অল্প সময়ের মধ্যে, সে এবার হাত তোলে। তার চোখেমুখে প্রবল ঘৃণা, আমাদের প্রতি। কেননা যে দুজন ষণ্ডামার্কা যাত্রী টিকেট হাতানোর অভিযোগে তার কলার চেপে ধরেছিল, আমরা তাদের সমর্থন জুগিয়েছিলাম প্রকাশ্যে ও মৌনভাবে। এবার সে তাই নিজের গলা চড়ায়।
আমার কিছু বলার আছে।
সার্জেন্ট তার দিকে তাকায়। সে ঝানু লোক, তার চোখেমুখে বুদ্ধির ঝিলিক দিব্যি খেলে যায়। সে জানে, পাবলিক আগুনের মতো তেঁতে আছে। একটু এদিক ওদিক হলেই তারা একটা হাঙ্গামা বাঁধাবে। তার আশ্চর্য লাগে, অভিযুক্ত ছেলেটিকে দেখে। পাবলিক যদি তাকে ঠেসে ধরে, তার জান কাবার হতে এক মিনিটও লাগবে না।
বলেন, আপনার কী হয়েছে।
ছেলেটি কলার চেপে ধরা সেই দুজনের দিকে ইশারা করে মুখ খোলে।
আমি আগেই টিকেট কাটছি, হাতে হাতে। অনলাইনে না। সেইটাই আমার ভুল হইছে। ২২ তারিখ বিকালে। আজ দুপুরে আমার ট্রেন। বাসায় গিয়া দেখি আমার টিকেটের ছাপার কালি স্পষ্ট না। কোন সিট আমার, প্রিন্ট বোঝা যায় না। মোবাইলে ফোন করছি, কেউ ফোন ধরে না। অনলাইনে টিকেট আবার কাটার চেষ্টা করছি, কাম হয় না। সেইজন্য আজ আবার নিজেই আসছি। আমি ভাবছিলাম যে তথ্যকেন্দ্রে জানালে তারাই এর ব্যবস্থা করবে। লাইনে দাঁড়ায থাকলে আমার আর কাউন্টার পর্যন্ত পৌঁছানো যাবে না। তথ্য কেন্দ্রের লোকটা বলছে যেই কাউন্টার থেকে টিকেট কাটছিলাম, সেই কাউন্টারে যেয়ে যোগাযোগ করতে। আমার আজ এখানে আসতে দেরি হয়ে গেছে। মেরুল বাড্ডা থেকে এখানে আসতেও অনেক জ্যামে পরতে হয়েছে। তাই আমি লাইনে খাড়া হই নাই বইলা এরা আমার গায়ে হাত তুলছে।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলতে থাকা ছেলেটির চোখজোড়ায় রাগ ও ক্ষোভের, হয়ত অপমানেরও, রাঙা আভাস। তার ক্লিনশেভড ফর্সা মুখ ও খাড়া নাকের ডগা লালচে হয়ে আছে। পাবলিক তার কোনো কথাই শুনতে চায় না। সে কাউকে বলার সুযোগ পায়নি যে সে আগেই টিকেট কেটেছে।
আপনি আগেই টিকেট কেটেছেন, সেই টিকেট টাকা দেয়ার সময় দেখে নেবেন না! দেখি আপনার টিকেট?
ছেলেটি টিকেট দেখালে সার্জেন্ট ব্যাপারটা বোঝে।
আপনি যদি আগেই জানাতেন যে আপনি টিকেট এখন কাটতে আসেননি, টিকেটকাটারের সঙ্গে কথা বলে এই ঝামেলা মেটাতে এসেছেন, তাহলে আপনাকে নিয়ে অন্যরা অহেতুক সন্দেহ করত না।
এই লোক সুবিধার না। সে কারো কুনো কথা শুনে না। মুখে তালা মাইরা থুইছে। সে একবারও কাউরে বলে নাই হ্যার কেইসটা কী! হ্যার মতো আরো কতজনই তো লাইনের মইদ্যে ঢুইকা পড়ে, এরে দিয়া তারে দিয়া টিকেট কাটায় কিছু মালপানি দিয়া, পিরিতের খাতির জমাইয়া।
বুড়োমতো খাটো লোকটির উত্তেজিত গলায় মিশে থাকা কটকটে আওয়াজ যেন বিঁধল সমবেত লোকজনের কানে। এ অভিযোগ তো মিথ্যা নয়। ৪ নম্বর কাউন্টারের লাইন আগের চেয়ে কিছুটা ছোট হয়েছে। ঘড়ির কাঁটায় দশটা পনের। আমার দুই হাঁটু টনটন করছে। এখনো সত্তর-আশিজন আমার সামনে। ধৈর্য তো আর ধারণ করতে পারি না! সার্জেন্টের দিকে মনোযোগ দিতে ইচ্ছা হয় না। পাবলিকের তাফালিং দেখতে, এই ভানুমতির খেইলের আসরে থাকতে আর ভালো লাগছে না। তলপেটে চাপ আসছে। তবু জোর করে নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করি। সার্জেন্টের গলায় এবার বক্তৃতা বাজে। তার চোখমুখ থমথমে দেখায়। শেভ করা শ্যামলা গালে উত্তেজনার দমকে ঘামের আভাস ফুৃটে ওঠে। বিশাল ছাদের নিচে খোলা চত্বর ময়দানের মতো ছড়ানো, অথচ কয়েক হাজার লোকের ঠাসাঠাসিতে এখন দম নেবার উপায় নেই। তীব্র গরমে অস্থির লাগে। ফ্যানের কোনো বন্দোবস্ত নেই, অথচ বাইরে তীব্র রোদের আঁচ। আমার ভেতরে বয়ে চলা রক্ত যে ফুটতে শুরু করেছে কোমরের ব্যথা ও টেনশনে, বুঝতে পারি বেশ।
আপনেরা নিজেদের মধ্যেই হান্দাহান্দি করেন। পাবলিকের তো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, নিজেদের গোয়া মারা মানে পেছনে লাগা ছাড়া। মুখ খারাপ করলে তো বলবেন আমার দোষ। আপনেরা খালি অন্যের দোষ ধরতে পারেন। আমি পাবলিকের সারভেন্ট, পেশায় রেল সার্জেন্ট। কিছুক্ষণ আগে আপনেরা ক্যাওয়াজ করছেন যে আমরা, রেল সার্জেন্টরা নাকি কাউন্টারের পিছনের দরজা দিয়া টিকেট কাইটা কালোবাজারীগো কাছে বেইচা দেই। তারা নাকি বেশি দামে পাবলিকের কাছে বেচে। আপনেরা যদি এত কিছুর খোঁজ রাখবার পারেন, তাইলে কালোবাজারীদের একটারে আইনা আমাদের কাছে ধরায় দ্যান না ক্যান! আমি তো হ্যাগোরে চিনি না! আপনেরা কেমতে চিনলেন হ্যাগোরে? হ্যাগো কপালে কি ‘কালোবাজারী’ সাইনবোর্ড লটকানো আছে, নাকি আমি ‘চোখ থাকিতে অন্ধ’? আপনেরা মন গড়া যা খুশি কইয়া একটা ঝামেলা পাকাইতে চান, মিডিয়ায় নিউজ কইরা ভাইরাল হইতে চান! এইসব আমরা বুঝি বইলাই অহনো এই লাইনে কইরা খাইতে পারি। দেহি, কার কত্ত সাহস যে এইহানে আইসা দশজনরে গ্রাহ্য না কইরা লাইন ভাইঙ্গা টিকেট কিনতে আসে! তেমুন কিছু হইলে আমি, এই সুরুজ মৃধা তার দুই হাতে হ্যান্ড কার্ফ পরায় থানার মধ্যে হান্দামু না!। পাবলিক আর কিছু পারুক আর না পারুক, খালি মুখে পারে। হের আছে টা কি! আমি তো আপনেগোর সারভেন্ট। আপনেরা কি কিছু করবার পারবেন? পাঁচ দিন ধইরা অনলাইনে টিকিট কাটন বন্ধ, আপনেরা কি পারছেন রাস্তায় নাইমা এর প্রতিবাদ করতে, নিউজপেপারে আপনেদের ভোগান্তির কথা লেখায় সাংবাদিকদের দিয়া কাম উদ্ধার করতে? আপনেরা খালি পারবেন কার গোয়া মারা যায়, হেই দিকে নজর দিতে। নিরীহ পাবলিকের আছেটা কি? খাড়া করলে সোনাটা, বুট করলে গোয়াটা। আপনেরা কি জানেন, আমরার মতো সার্জেন্টরে ডেইলি ৩০টা টিকেট সেল করন লাগে? আমি যুদি এই ৩০ খান টিকেট বেচবার বন্দোবস্ত করতে না পারি, উপর থিকা আমারে জলদি বদলি করা হবে! খাগড়াছড়ি নয়ত বান্দরবনে পোস্টিং দিবে! তখন আমার বউ পোলাপানরে পাবলিকে ডেইলি উঠতে বসতে গোয়া মারা দেবে! মিনিস্টার থেইকা শুরু কইরা রেলের এই পোস্ট সেই পোস্টের কতজনের ডেইলি রেল টিকেট লাগে, হেই খোঁজ আছে আপনেগো? আপনেরা বেবাকে আছেন খালি নিজেগো তালে। অই মিয়া, যান, আপনে আপনের কাম সাইরা জলদি কাউন্টার ছাইড়া বাইরায় যান। কেউ লাইনের সিরিয়াল ভাঙবেন না, কেওয়াজ করবেন না। এরপর যুদি কুনো হাঙ্কিপাঙ্কি হয়, আমি কিন্তু থানায় খবর দিমু। অ্যাকশনে যামু।
আধ ঘণ্টা পর। মাথা ধরেছে প্রচণ্ড। পেটে ক্ষুধাও লেগেছে বেদম। তলপেট খালি না করে আর উপায় নেই। আমার পেছনের জনকে বললাম, একটু ঘুরে আসি। আমার জায়গা সামলানোর ভার তার। এর আগে ওনারটা আমি সামলেছি। কাজ উদ্ধার করতে হলে নিজেদের মধ্যে এসব কৌশল আপসে আপ করতে হয়। তিনি সায় দিলেন। তার চোখেমুখে উদ্বেগের কালো ছায়া। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। আগামীকালের ট্রেন যেভাবেই হোক ধরতে হবে তাকে। অথচ এখনো তার টিকেট পাবার নিশ্চয়তা নেই। অনলাইনে নাকি বুকিং শুরু হয়েছে, তাই তার টেনশন আরো বাড়ছে। তিনি তো মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন না! আমি কিছু বললাম না। তার মতো মনের ভেতরটা আমারও একইরকম। অনলাইনে বুকিং শুরু হয়নি, সম্ভবত। কারণ সার্ভার কাজ করছে না। ওটা আ্যাকটিভ হলে তো আমাকে লাইনের এই নরকে দাঁড়িয়ে থাকতে হত না! আমি আর কথা বাড়ালাম না। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে চারপাশে একটু ঘুরলাম। চত্বরে ওঠার সিঁড়ি পেরিয়ে কাউন্টারগুলোর সামনে ভিড় করে টিকেট কাটতে উৎসুক লোকজনের লাইন পেছন দিকে এগিয়েছে বহুদূর স্টেশনের কম্পাউন্ডে ঢোকার চওড়া মূল রাস্তার ওপর। খা খা রোদে বয়স্ক মহিলা, ন্যাতানো বৃদ্ধ, কোলে বাচ্চা নিয়ে হাঁপাতে থাকা মাঝবয়সী বেটি, কিশোরী, যুবকসহ বিভিন্ন বয়সের লোকজনের দিকে তাকিয়ে এর মধ্যে নিজেকেও যেন খুঁজতে লাগলাম। একবার মনে এ ভাবনা উঁকি দিল, আমি আসলে কেন বাইরে বেরিয়ে এসেছি! টয়লেটে যাবার জন্যই, নাকি ব্ল্যাক টিকেট কেনার ফিকির আমার আছে! চারপাশে কড়া চোখ রাখলাম। কেউ আমাকে খেয়াল করছে না তো! পুলিশ, আনসারের লোকজন তক্কে তক্কে নেই তো এত মানুষের ভিড়, এছাড়া পথচলতি লোকজন তো আছেই! কিন্তু যারা দালাল আর ব্ল্যাকে টিকেট বেচে, তাদের কারো হদিশই তো মিলছে না! কাউকে দেখেই তো মনে হচ্ছে না যে চোখের ইশারায় বা বা হাত নেড়ে কেউ আমার মনোযোগ পেতে চাইছে! আচ্ছা, আমার যে টিকেট প্রয়োজন আর এ ব্যাপারে আমি যে এমন কারো সাহায্য চাই, তা তাদের কীভাবে বোঝাব? দালাল বা র্যাকাররা যে আছে চারপাশে, তা তো মিত্যে নয়! অবশ্য ব্যাপারটা যে সত্যি, সেই প্রমাণও আমার কাছে নেই! তাহলে সবটাই কি বানোয়াট ব্যাপার! পাবলিকের কি খেয়ে দেয়ে কাজ নেই যে ব্ল্যাকার বলে কাউকে অভিযুক্ত করতে যাবে! আগে তো ধরা পড়ত! আমি অবশ্য ভাসা ভাসা শুনেছি, কখনো ব্ল্যাকারদের বা দালালদের দেখিনি! তাদের আমি চিনি না, তারাও আমাকে চেনে না। অথচ মাঝখানে আছে পাবলিক আর আইনের লোকজন। সিসিটিভিতে আমার গতিবিধি খেয়াল করা হচ্ছে না তো! অমনি গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। পড়িমরি করে ছুটলাম এই অহেতুক ঘোরাঘুরি বাদ দিয়ে। কিন্তু তাতে বড্ড বেচাল এক ঘটনা ঘটল। কখন যে পাবলিক টয়লেটের দরজা খুলে ভেতওে ঢুকে চোখ বন্ধ কওে কলজের ধড়ফড়ানি থামাতে চোখ বুজেছি, খেয়ালই নেই! মাথার ভেতর রাজ্যের যত কোলাহল আর আরেকটা টিকেট কাউন্টারের ভিড় আবার বুঝি আসর বসিয়েছে! পাবলিকের গিজগিজে ভিড়ের মধ্যে আমি হঠাৎ যেন চোখের সামনে সর্ষে ফুলের ক্ষেত দেখলাম। কিছুক্ষণের জন্য যেন ব্ল্যাকআউট হলো। একসময় হুশ ফিরতেই দেখি অনেকে আমার চোখের সামনে ঝুঁকে আছে। তার মানে তারা আমাকে অজ্ঞান ভেবেছিল! কী সব যেন বলছে তারা। কেবল একটি মুখ যেন চেনা চেনা লাগছে। সেটা সেই সার্জেন্টের মুখ। সে যেন বলছে, এই আগুনের বাজারে আঠারো হাজার টাকা বেতন দিয়া কী হয়? কতজনে কেমতে কেমতে লালে লাল অইয়া গেল। সিটি করপোরেশনের মেথর হালার পোর ঢাকা শহরে দশ তলা বাড়ি, পাজেরো গাড়ি আছে। আমার কি বালটা আছে! পাবলিকরে যত আদর করি, হ্যায় তত চোটপাট দেখায়! শালার পাবলিকের গুষ্টি কিলাই! এই যে পাবলিক, এই পাবলিকের মইদ্যেই আছে যত চোর বাটপার গাঞ্জাখোর ধইঞ্চা হিরোইঞ্চি ডাইলখোর। কন দেহি আপনেরা, এরা কেমুন পাবলিক! নিশার ট্যাকা জোগানোর লাইগা এরা পকেটে বেলেড রাখে। পাবলিকের পকেট মাইরা মানিব্যাগ, মোবাইল খসায়। দেইখেন ভদ্রলোকেরা, আপনেরা নিজেগো পকেট সামলাইয়েন। যুদি কেউ কন যে পকেটের মোবাইল নাই, মানিব্যাগ খুঁইজা পাই না, আমি কিন্তু কিচ্ছু করবার পারুম না। হ্যারাও তো পাবলিক। এত্তটি পাবলিকের মইদ্যে আমি বুঝুম ক্যামতে, কেডা ক্রিমিনাল আর কেডা ফিরিশতা? তহন যুদি কেউ থানায় গিয়া চোটপাট দেহান, আমরা কিচ্ছু করবার পারমু না, আঙুলটা চুষণ ছাড়া। এই যে আপনে, ইনভার্সিটির টিচার, আপনের মতলবখান তো সুবিধার ঠ্যাকে না! আপনের চোখ দেইখা, চোরা চাউনি দেইখাই ঠাগর করবার পারি, আপনের প্যাটে কোনো মতলব আছে। নাইলে আপনে লাইন ছাইড়া এইহানে রং তামাশা করতে আসছেন। ঠোলাগো খুঁইজা বাইর করবার চান, ব্ল্যাকে টিকেট কিনবার চান, না? আমার কাছে একখান টিকেট আছে। লইবেন? তাইলে এক কাম করেন। কেউরে কিছু কওনের কাম নাই। চুপে চুপে আমার লগে আহেন।
আমি ভিড় থেকে বেরিয়ে সার্জেন্টের পিছে পিছে হাঁটতে থাকি। সে আমাকে তার রুমে এনে বসায়। তারপর ভিতর থেকে ছিটকিনিটা লাগিয়ে দেয়।
কন দেহি, কী মতলব আপনের! সাড়ে তিন ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ায়া ছিলেন, ওইখান থেইকা সইরা আইলেন ক্যান!
আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি বেকুবের মতো। সে তো আমাকে টিকেট দেবার কথা বলে এখানে ডেকে এনেছে। এখন এখানে এনে জেরা করার কারণটা কী? অবশ্য মুখে কিছু না বলে আমি চুপ থাকি।
মুখে তালা দিছেন? আমার কাছে তালা খুলনের চাবি আছে।
আপনি এসব কী বলছেন? আমি এমনি ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। অনেকক্ষণ লাইনের মধ্যে থেকে দম আটকে আসছিল। বাথরুম পেয়েছিল। তাই লাইন ছেড়ে এসেছি। একটু পরই লাইনে ঢুকব।
আইচ্ছা! অইন্ন লোকের উপর আপনে দায়িত্ব চাপায়া রিল্যাক্স করতে বাইরইছেন! হাওয়া না খাইলে আপনের মন ভরব না!
আমি লাইনে যাব।
এইহানে আপনে ক্যান আসছেন? টিকেটের লাইগা?
আমি বুঝতে পারি না, এই বদমাশকে কী বলব!
এই যে, টিকেট। ধরেন।
সে পকেট থেকে একটা টিকেট বের করে। আমার দুই চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। আমার বিশ্বাস হয় না, এটা সে আমাকে দিচ্ছে।
কত দাম এটার?
আপনে কত দিবার পারবেন?
যা লেখা আছে, তা পাবেন।
হেইডা তো লাইনে খাড়ানো পাবলিকের লাইগা, কাউন্টার থিকা কাডনের দাম। আমি যে আপনেরে লাইনে দাঁড়ানির যন্ত্রণা থেইকা মুক্তি দিলাম, নিজের পকেটের মাল খসায় এইটা কিনা আনলাম, আপনের লাইগা এইটা রিজার্ভ রাখলাম, হেগুলির দাম কত ধরছেন?
আচ্ছা, টিকেটের দামের দ্বিগুণ নেন।
টিকেট আমার চাই-ই চাই! তিনগুণ দাম দিয়ে হলেও।
এইডারে কী বলে, কন দেহি! আপনে তো ইনভার্সিটির পোরফেসার! শিক্ষিত মানুষ!
আমার মুখ কালো হয়ে যায়। মনে হয়, সে আমার মুখে থুতু ছিটিয়ে দিয়েছে।
এইডারে বলে ব্ল্যাক করা, মানে কালোবাজারী। পাবলিক টিকেট পায় না, আর আপনেগো লাইগা আমারে ব্ল্যাক টিকেটের বন্দোবস্ত করতে হয়। ব্ল্যাকে যে টিকেটের দাম বেশি, এইডা জানেন!
আমি তো বেশি দামই দিচ্ছি। টিকেটের দামের দ্বিগুণ।
অইব না। আরো লাগব।
আরো কত?
আপনে কত দিবার পারবেন?
আমার কাছে আর নাই।
কত আছে? দেহি মানিব্যাগ!
আমি মানিব্যাগটা প্যান্টের পেছনের পকেট থেকে টেনে বের করতে তার টেবিলের সামনে রাখা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। সে আমার পেছনে এসে দাঁড়ায়। আমি টের পাই তার হাতের লাঠিটা আমার প্যান্টের জিপারের সামনে আস্তে আস্তে ঘষা খাচ্ছে। অপমানে আমার চোখমুখ লাল হয়ে যায়। কিন্তু সে এইদিকে গ্রাহ্যই করে না।
আপনে ইনভারসিটির পোরফেসার অইয়া রিকশাওয়ালা, দোকানদার, গাঞ্জাখোর, হিরোইঞ্চি, বাড়ির ভাড়াটিয়াগো লাইনে পাবলিক সাইজা খাড়াইছেন ক্যান! আপনের তো ব্ল্যাকের টিকেটের ডিমান্ড! এতক্ষণ হুদাহুদি নষ্ট করলেন!
আমি তো আপনাকে আগে চিনতাম না!
অহনে চিনবার পারছেন!
জ্বি।
ভালা! দেহি কেমুন চিনছেন।
সে পকেট থেকে হ্যান্ডকার্ফটা বের করে আমার দুই হাতে পরিয়ে তালা লাগিয়ে চাবিটা শার্টের বুকপকেটে রাখে। আমি কিছুই বলতে পারি না। হতভম্ব হয়ে তার কাণ্ড দেখতে থাকি।
আপনে পাবলিক, নানি নন পাবলিক?
আমি কথা বলি না। রাগে আমার চোখমুখ জ্বলতে থাকে।
লাইনে যেহেতু খাড়াইছেন পাবলিকের সঙ্গে মিল্লাঝিল্লা, তাইলে আপনে পাবলিক। ঠিক বলছি?
জ্বি।
আইচ্ছা। কন তো, পাবলিকের দুইটা জিনিস থাকে। আমি আগে আপনেরে বলছিলাম। মনে আছে।
জ্বি।
তাইলে বলেন।
আমি চোখ বন্ধ করে থাকি।
খাড়া হইলে পাবলিকের থাকে সোনাটা, মানে ধোনটা, বুট করলে গোয়াটা। বুঝলেন?
আমি কথার জবাব দিই না।
সে হাতের লাঠিটা দিয়ে আমার প্যান্টের জিপারের চারপাশে জোরে জোরে চাপ দিতে থাকে। আমি টের পাই, তার উত্থিত পুরুষাঙ্গ আমার পেছনে যেনঠেসে ধরা হয়েছে। সেটার কঠোর স্পর্শ আমার মনে ক্লেদাক্ততা সৃষ্টি করে। আমি নিজেকে সরিয়ে নিতে চেষ্টা করামাত্রই সে পেছন থেকে আমাকে জাপটে ধরে। বাম হাত দিয়ে সে আমার প্যান্টের বেল্টের কাছে ধরে ডান হাত দিয়ে জিপারটা টেনে খোলে।
এর আগে কয়বার ব্ল্যাকে টিকেট নিছেন?
নেইনি, কখনো।
তাইলে এইবার নিতে আইলেন ক্যান?
টিকেটটা পাওয়া জরুরি।
কী কাম? কই যাইবেন?
অফিসিয়াল কাম। সিলেটে যাব।
চা বাগানের হাওয়া খাইতে! হেইখানের কুলি মাগীগো চুদতে! পেলেনে গেলেন না ক্যান!
তার বাম হাতের মোটামোটা আঙুলগুলো আমার উত্থিত পুরুষাঙ্গকে ততক্ষণে জিপারের বাইরে টেনে বের করেছে।
সাইজ তো ভালোই বানাইছেন। বউরে ডেইলি ঢুকান কয়বার?
অপমানের ব্যাপারটা আগেই মাথা থেকে সরিয়ে ফেলেছিলাম। এরপর আমাকে যা তাড়া করেছিল, সেটা ছিল নির্ঘাত বুনো শুয়োরের গোঁ। আমি এবার ক্ষেপে গিয়ে তাকে পেছন দিকে ধাক্কা দিই। সে এজন্য প্রস্তুত ছিল না। ফলে দুমদাম আওয়াজ তুলে টেবিলের সামনে রাখা স্টিলের চকচকে হাতললাগানো মসৃণ চামড়ার ঢাকনাওয়ালা ভারী চেয়ারের ওপর আছড়ে পড়ে। আমি ছুটে গিয়ে দরজার ছিটকিনি টেনে খুলব, ঠিক তখন সে আমার পা ধরে টান দিলে আমি হোচট খেয়ে পড়ি মেঝের ওপর। সে আমাকে চিৎ করিয়ে শোয়ায়। তারপর দুই পা জোর করে যতদূর সম্ভব ফাঁক করে উঠে বসে। এখন তার মুখে অপার্থিব হাসি। সে পরনের শার্টটা খুলে ফেলেছে। ব্যায়াম করা তাগড়া শরীরে একফোঁটা মেদ নেই। সে পরনের প্যান্ট খুলে ফেলে। তার পরনে শুধু লাল আন্ডারওয়্যার। তারপর জোর করে আমার পুরুষাঙ্গটা দুই হাত দিয়ে ধীরে ধীরে ঝাঁকাতে থাকে।
টিকেট ব্ল্যাকে নেয়ার মজা আইজ তরে দেখামু, চান্দু। তুই পাবলিক? তরে আজ পাবলিক চিনামু। তুই পাবলিক, আর পাবলিক না, কী কস! এগার বছর চাকরি আমার, আমি তর কাছতে পাবলিক চিনুম, হাউয়ার পোলা! তুই হারুন মিরধারে জন্মের মতো চিননা রাখ।
আমি দুই পা নাড়ানোর চেষ্টা করি। কিন্তু তার সঙ্গে আমি গায়ের জোরে পারব কীভাবে? সে নিজের পরনের খুলে রাখা স্যান্ডো গেঞ্জিটা আমার মুখে গুঁজে দেয়। তারপর জোর করে উল্টো করে আমার ওপর শুয়ে পড়ে। আমি টের পাই, সে যেন আমার ভেতরে প্রবেশ করতে চাইছে। আমি তার মতলব বুঝে উঠে যত জোরে চেঁচাতে চেষ্টা করি, সে ততই জাপটে ধরে আমার ভেতর ঢুকতে চায়। একসময় টের পাই, তার উত্থিত বিশাল পুরুষাঙ্গটা আমার ভেতরে ঢুকে গেছে। প্রচণ্ড ব্যথায় আমি ককিয়ে উঠি। কিন্তু মুখ দিয়ে গো গো আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বের হয় না।
শালা, ব্ল্যাকে টিকেট নিবার আইছস, না?
সে তার কোমর অবিরাম দোলাতে থাকে। এদিকে বাম হাত দিয়ে আমার পুরুষাঙ্গটা ঝাঁকিয়ে রেতঃপাত ঘটায়। তাতেও তার উত্তেজনার অবসান হয় না। আমি টের পাই, পিঠের নিচটা বারবার থরথর করে কাঁপছে। যেন ভূমিকম্প হচ্ছে, আর আমি আতঙ্কের শেষ সীমায় পৌঁছে তলিয়ে যাচ্ছি অচেনা এক দুনিয়ায়। খানিক পরে সে প্রচণ্ড আওয়াজ করে গোঙাতে থাকলে আমি টের পাই আমার কালি গা ভিজে যাচ্ছে তার উৎক্ষিপ্ত তরলে। তার গলায় পরম পরিতৃপ্তিজনিত উল্লাস। আমার পেছনটা রক্তে ভিজে চিটচিটে হয়ে আছে। সে আমার মুখে গুঁজে দেওয়া নোংরা গেঞ্জি টেনে খুলে নিজেকে মোছে। এমন সময় বাইরে থেকে বহুজনের সম্মিলিত হুঙ্কার শোনা যায়। প্রবল আতঙ্কে আমি নিজেকে লুকাতে রুমের এদিকে সেদিকে তাকাই। এমন সময় বন্ধ দরজার ছিটকিনি খুলে গেলে আমি হতভম্ব হয়ে দেখি, সেই সার্জেন্ট পাবলিক টয়লেট থেকে বেরিয়ে আসছে। তার পরনে লাল রঙের সেই আন্ডারওয়্যারটি, স্যান্ডো গেঞ্জি আর নেভি ব্লু ইউনিফর্মের নিচে সে ইন ঠিকঠাক করতে করতে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। যেন সে বোঝাতে চায়, পাবলিক টয়লেটে অনেকটা সময় ব্যক্তিগত কাজে খরচ করার জন্য সে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। তার গলা চিনতে আমার ভুল হয়নি। একটু আগেই সে যে বন্ধ দরজার ওপার থেকে চরম পুলকলাভজনিত উল্লাসে মেতে উঠে আমাকে গোলকধাঁধায় বন্দী করেছিল, তাতে আমার আর কোনো সন্দেহ রইল না। এবার নিজেকে সেই দরজার আড়ালে বন্দী করে নিজেকে ভালোভাবে খেয়াল করি। না, সবকিছু ঠিকঠাকই আছে। আমার গায়ে রক্তপাতের কোনো চিহ্নই নেই। কিন্তু নিজেকে এই ছোট টয়লেটের চার দেয়ালের সংকীর্ণ পরিসরে দেখতে কেন যেন গা ঘিনঘিন করছিল। কারণ ততক্ষণে আমার চোখ পরেছে দরজার বামদিকের অশ্লীল একটি দেয়ালচিত্রের ওপর উৎক্ষিপ্ত থকথকে সাদা তরলের দিকে। সার্জেন্টের সংলাপ আর এই দৃশ্যের সঙ্গে খানিক আগে কল্পলোকে ভেসে থাকা ঘটনাগুলোর সংযোগ বুঝে ওঠার আগেই দরজার ওপাশ থেকে কারো গলা খাঁকানোর ইঙ্গিত বুঝে ঝটপট নিজের কাজ সেরে সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম।
মোবাইলের দশটা সাতচল্লিশ। লাইন অনেকটাই এগিয়েছে। অনলাইনে নাকি টিকেট বিক্রি চলছে। ফলে অনেকে লাইন ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু আমার তো মোবাইলে টাকা রিচার্জ করা নেই। এখানে কোথায় আছে রিচার্জ করার বন্দোবস্ত, কে জানে! আমার পেছনের বা সামনের লোকটিকে লাইনে দেখতে পেলাম না। অমনি আমার বুক ধক করে উঠল! কী সর্বনাশ! এখন তাহলে আমাকে এই বিশাল লাইনের শেষ মাথায় গিযে দাঁড়াতে হবে। আমার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো সেই সার্জেন্টের মুচকি হাসিটা। সেই হাসিতে কি কোনো ইঙ্গিত ছিল! এখন আমার জন্য তিনটা পথ খোলা আছে। হয় বিশাল লাইনের শেষমাথায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে, নয়ত সেই সার্জেন্টের দ্বারস্থ হতে হবে। আর নয়ত অনলাইনে টিকেট কাটার বন্দোবস্ত করতে হবে। তৃতীয়তটাই একমাত্র করণীয়, ভেবে লাইন থেকে সরে গিয়ে কাউন্টারের কাছে দাঁড়ানো সার্জেন্টের দিকে তাকিয়ে ইশারায় হাত নাড়লাম। সার্জেন্ট তখনই সদ্য কেনা টিকেটগুলো মানিব্যাগে ঢুকিয়ে সেটা রাখছিল প্যান্টের পেছনের পকেটে। আমার চোখের কাতর দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে সে কিছু একটা বুঝে নিল। তারপর লাইনের বাইরে বেরিয়ে আসতেই আমি তার কাছে জানতে চাইলাম, অনলাইন টিকেট কেনার কোনো বন্দোবস্ত এখানে আছে কি না। সে জানাল, ওভাবে এখনো টিকেট বিক্রি শুরু হয়নি। তবে আমি যে রুটের টিকেট চাই, তার কাছে দুটো টিকেট আছে। একজন যাবে না, ফলে তার জন্য কেনা টিকেটটি সার্জেন্ট আমাকে দিতে পারবে।
অইদিকে চলেন। আমি এ পেছনের বিল্ডিংয়ের তিনতলায় বসি। আমার রুমে গিয়া কথা কই।
প্রচণ্ড গরমে সে গলগল করে ঘামছিল। প্যান্টের বাম পকেট থেকে রুমাল বের করে সে প্রথমে গলা, এরপর নেভি ব্ল ইউনিফর্মের বোতামজোড়া খুলতেই লোমশ বুকের ওপরে চাপানো তারসাদা স্যান্ডো গেঞ্জিটা আমার চোখে পড়ে। অমনি আমার মাথাটা যেন দুলে ওঠে। সে ততক্ষণে কাউন্টারের চত্বর পেরিয়ে বামপাশের বাঁকানো চওড়া সিঁড়ি ভেঙে উঠতে শুরু করেছে। আমি তার একথা সেকথার সঙ্গে হু হা বলে চলেছি পা ফেলে ফেলে। একসময় তিনতলার সারি সারি রুমের একটার সামনে এসে দাঁড়ালাম।
এটাই আমার রুম। এখানেই অন ডিউটিতে রেল সার্জেন্টরা বসে। আপনি ভেতরে আসুন।
লোকটার দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে এতক্ষণে একটা ব্যাপার আমার চোখে পরে। এতক্ষণ কেন আমি তা খেয়াল করিনি, কে জানে! তার ইউনিফর্মের ডান পকেটের ওপরে নেভি ব্ল রঙা প্লাস্টিকের ব্যাচের ভেতরে সাদা হরফে একটা নাম। ডানদিকের পকেটের নিচে কালোর ভেতর রূপালি রঙের একটা পদক। লোকটি ঝকঝকে দাঁত বের করে মৃদু হেসে আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করল। তারপর তালাবদ্ধ রুমটা খুলে রুমের ভেতরের সাদা আলো জ্বেলে দেয়ালে ঝোলানো শাটারগুলো টেনে বন্ধ করে দিল। রুমের দরজার লকারটা ভেতর থেকে আটকাল। অফিসিয়াল একটা রুম দেখতে যেমন হয়, এটাও তেমন রুম। কোনো বিশেষত্ব নেই। টেবিল, চেয়ার, কাচের সোকেস, নিউজপেপার, কিছু বই আর দেয়ালে টানানো কয়েকটা ছবি মিলিয়ে সেভাবেই এ রুমটা সাজানো হয়েছে।
প্লিজ বসুন, প্রফেসর সাহেব। এই যে আপনার টিকেট।
লোকটি দুই পা ফাঁক করে মাথায় পরিহিত ক্যাপটা খুলে রাখল। চকচকে টাকের ওপর সাদা আলো পরতেই জাদুমন্ত্রে লোকটা যেন একটা দৈত্যে পরিণত হল। এক টানে সে ঘামে ভেজা ইউনিফর্মটা খুলে টেবিলের পাশে দাঁড় করানো হুকারে সেটা ঝুলিয়ে রাখল।
আপনার একটা টিকেট লাগব। তাই না?
জ্বি।
কোন রুটের? সিলেটের!
আমি চমকে উঠি।
আপনি তো পরীক্ষার কাজে ওইহানের ইনভারসিটি যাইবেন!
আপনি কীভাবে জানলেন!
ভালা কথা, ঐ রুটের রেগুলার টিকেট আর নাই। সব সেল হয়ে গেছে।
অসম্ভব। গত ২৪ তারিখে আমাকে তথ্য কেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছে যে আজ সকাল থেকে এ রুটের টিকেট বিক্রি শুরু হবে। তাছাড়া আমি তো আজকের বা আগামীকালের টিকেট কাটছি না। আমি কাটব ৩০ তারিখের টিকেট।
আপনি ব্ল্যাক টিকেট কাটতে আইছেন! তাই না?
সে পকেট থেকে একতোড়া টিকেট দেখায়। সেগুলো সব সিলেটের, আগামী পাঁচ দিনের। সেখানে কী একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন হবে। সব টিকেট সেল হয়ে গেছে।
আমি বেবাক টিকেট কিননা ফেলাইছি। আপনে আমারে কী বলবেন? চোরা কারবারী, নাকি মজুতদার, নাকি ব্ল্যাক টিকেটার?
সে টেবিলের ড্রয়ার থেকে হ্যান্ড কার্ফ বের করে। তারপর আমাকে চেয়ার থেকে টেনে দাঁড় করায়।
ব্ল্যাক টিকেট কেনার দায়ে আপনেরে আমি অ্যারেস্ট করলাম। আপনের কিছু বলার আছে?
এমন সময় আমার চোখ যায় তার ডান পকেটের দিকে। তার নেমপ্লেটটা আগে খেয়াল করিনি। এবার সেদিকে আমার চোখ যেতেই কিছু ভেবে ওঠার আগে আমি ডান হাটুঁ দিয়ে তার দুই উরুর সংযোগস্থলে সর্বশক্তিতে কিক করি। সে সঙ্গে সঙ্গে কাবু হয়ে যায় পুরুষের দুর্বলতম ও শক্তিশালীতম অঙ্গটির প্রচণ্ড দুর্দশায়, ব্যথায় মুষড়ে গিয়ে। ছিটকে যায় সে, ঘরের মেঝেতে। আমার মাথা আর যেন কাজ করে না। বুকের ভেতরটা ধুকপুক করতে থাকে। দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে। বন্ধ দরজার হাতলটায় প্রাণপণ মোচড় দিই। সেটা খুলে গেলে আমি প্রায় দৌড়ে নামি বাঁকানো সিঁড়িগুলো বেয়ে। নেভি ব্ল নেমপ্লেটের ভেতরে লেখা নামটা আমাকে তাড়া করতে থাকে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা ধপ ধপ পায়ের আওয়াজতোলা দৈত্যটা আমাকে বুঝি এখনই পাকড়াও করবে। তার নাম হারুন মৃধা।
তাশরিক-ই-হাবিব
কথাশিল্পী ও সম্পাদক, পরানকথা সাময়িকী
সহযোগী অধ্যাপক
বাংলা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
০১৭২৬৯৭৮১৫৭