ওবায়েদ আকাশের কবিতা
বড়লোকের ঘোড়ারোগ
বাড়ির যাবতীয় আসবাবপত্র বিক্রি করে
একটি মরুভূমির ঘোড়া কিনে এনেছি
সবাই বলল, এটাই তো চেয়েছিলাম!
তবে যেহেতু মরুভূমির ঘোড়া
উট হলেই জমত দারুণ
তবু নিয়ম করে ঘোড়ার যত্নআত্তি করি
রাত এলে শূন্য ঘরে মাদুর পেতে ঘুমাই
বাজারঘাট, যত্রতত্র ঘোড়ার পিঠে ঘুড়ি, দেখি
শরীরের কোনায় কোনায় লাফিয়ে ওঠে ঘোড়ারোগ
এবার মরুভূমির উটের কথা ভাবি-
আমার সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে ঘোড়ারোগ
বউ বলে, আপনার যা হাল! আপনি চিকিৎসা করান!
বলতে বলতে ঘরের বেবাক মাদুর পানির দরে বিক্রি করে দেয়
বাড়ির শিশু-বৃদ্ধ, যুবক-যুবতী ঘোড়ার পিঠে লাফালাফি করে
ফলে আমাদের সমগ্র বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে ঘোড়ারোগ!
স্বাক্ষর
ছিটমহলের অতীত আর রোহিঙ্গাদের
ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই আমার মন ভারি করতে আসে-
আমি তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে একপ্রকার চোরাস্রোত বয়ে যেতে দেখি-
দেখি তাদের একজন রোহিঙ্গা আর একজন ছিটমহলের অতীত বাসিন্দা
অন্যায্য সংলাপে তারা তাদের পরিচয়পত্র হারিয়ে ফেলেছে
কিংবা পরিচয় নিশ্চিত করতেই ঘাম ঝরিয়ে দিচ্ছে-
আমি তাদের মাতৃভাষায় বললাম-
স্বভাষায় আপনাদের বিভ্রান্তি সংক্রান্ত একটি স্বাক্ষর বসিয়ে যান
যা আপনাদের একটা হিল্লে হবার পর বিবেচিত হতে পারে-
তাদের স্বাক্ষর পড়ে বুঝলাম, একজন হোমিনিডি আর একজন
হোমো স্যাপিয়েন্স পর্যন্ত লিখতে পেরেছে-
এরপর ছিটমহল তার দীর্ঘ গ্রীবা বাড়িয়ে দিল
হারানো বাসিন্দার খোঁজে
এবং রোহিঙ্গার গজিয়ে উঠল ডানা
উড়তে থাকল প্রবল ঘূর্ণিতে, ঠিকানাবিহীন
এ গান শীতল
(কবি, নন্দনতাত্ত্বিক ও বন্ধু মাহফুজ আল-হোসেন)
ওভাবে বলো না- গলিত যাত্রা পড়ে আছে দূরে
হারাবার প্রার্থনা ঘিরে ব্যথা
যদিবা আমূল বদলানো যেত
যেতাম- প্রতিটা অক্ষর বুকে টেনে নিয়ে
খসে খসে পড়তাম- নির্জন ভিড়ে
ওভাবে ডেকো না- তারার পরীরা কখনো জ্বলে না
তারারাই বাঁচে- তুমুল শিকলে
যতটা কাঠের রচনা- শিখেছ প্রণত বৃক্ষে
অন্তত রয়েসয়ে বলো কিছু- গাছেরা ঘামছে
তারো প্রাণ আছে- পারদ গলছে
ওভাবে বলো না- হিজল নুয়েছে নদীতে কতটা
ঝাউ বড় হলে- দেখো উঁচু হতে হতে আরো দূর
বিপুলে হারায়- তুমি তা পারো না
ওভাবে বলো না- রয়েসয়ে বলো- শুনছে কথারা
বিরুদ্ধ পৃথবী- আলোরা নিভেছে- এ গান শীতল!
প্রতিবাদের চাষবাস
বলতে বলতে ভোঁতা হয়ে গেছি যে
আমি আসলে কোনো কিছুরই প্রতিবাদ করতে পারি না
দূর নভোনীলে ট্রাক কিংবা অথৈ সমুদ্রে উড়োজাহাজের পাখা ঝাপটানি দেখলেও
মধ্যবিত্তিক ব্যাকুলতা থেকে কেউ আমাকে টেনে তুলতে পারে না
যেদিন একটি মৃত ঘোড়াকে বিষাক্ত ভেবে দূরে কোথাও ফেলে দেয়া হলো
তবু তার মাংস খেতে প্রবৃত্ত হলো কতিপয় ক্ষুধার্ত মানুষ
এইবার একটা প্রতিবাদ করবোই ভেবে মৃত ঘোড়াটির গন্ধ ঘেঁষে বসি
আর যেসব দুর্ভাগা মৃত ঘোড়ার মাংস খাচ্ছে আর
মুহূর্তে ছটফট করে মরে যাচ্ছে
এবার আরো রেগে গিয়ে, ওদের সাথে আমিও মাংস খেতে বসি-
ফলে যা হবার তাই হয়!
মনে মনে ভাবি, এবার দাঁড়িয়ে গেলে
প্রতিবাদ কথাটি দিয়ে আমি একটি ফুটবল বানিয়ে সমুদ্রে ছুড়ে দেবো
আর যাই হোক, গভীর সমুদ্রে কখনো ফুটবল খেলা যায় না
তখন কেউ আমারে ফিসফিস করে বলল
পৃথিবীতে বিগত মানুষেরা কখনো উজান বাইতে পারে না
যদি পারো, ঘোড়ার নিমিত্ত যিনি, তার কাঁধে প্রকাণ্ড জোয়াল জুড়ে দাও
নিরন্তর চাষবাস করো বিবিধ উজ্জ্বল মেধার!
একজন কেউ মৃত ঘোড়াটিকে মাটিতে পুঁতে দেবে!
আজকাল যেখানে যাই
ঘুরতে ঘুরতে আমরা নদীর কাছে যাই-
নদীরা মরতে মরতে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠে
একদিন ক্ষমতার পিঠে জাহাজ চাপিয়ে
সমুদ্রের কাছে যাবো-
মরুভূমির মতো চিৎকার করে বলবো-
ভাগ্যাহত প্রতিটি উটের হত্যার বিপরীতে
বেড়ে যাচ্ছে মরুভূমির প্রাত্যহিক দীর্ঘশ্বাস
প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস ধরে হেঁটে হেঁটে
অবশিষ্ট অরণ্যের কাছে যাই-
দাবানল ঠোঁটে ঘরে ফিরে এসে মুখ থুবড়ে পড়ি
আমরা সবুজে সবুজ ঘষে আগুন জ্বালাতে পারি-
আমরা মাছের খোলস পরে করুণ মৃত্তিকা ধরে হাঁটি-
দু’দণ্ড শুশ্রূষা পেতে প্রকৃতির কোল ঘেঁষে বসি-
আর তারা মরে যেতে যেতে করুণ শ্মশান হয়ে ওঠে
তোমার জীবনী
আঁধার থেকে গলতে গলতে এখন
হিমাঙ্কের নিভৃতি বলে নিজেকে প্রমাণ করছ
ধাতব সত্যের মতো রহস্যময়তা
আর বিজ্ঞানের বিস্ময় সকাশে দাঁড়িয়ে
বুঝিয়ে দিয়েছ তোমাকে ঘিরে যুগের পর যুগ
কতটা সময় গবেষণাগারে ফুরিয়ে গেছে পৃথিবীর
নিরন্তর টেট্রন বালিশের ধারে
কেটে কেটে রক্তাক্ত হচ্ছে ঘুমের কার্পাস
কোনো কোনো তন্দ্রাচ্ছন্ন মুখ আর কোনোদিন
দেখবে না পৃথিবীর অবাক সুন্দর স্বরূপ
তবু ঘুম ভালবেসে মানুষ চারপাশ ঘিরে
দিনের পর দিন কেটে চলেছে সমুদ্র পরিখা
বুকের একান্ত কাছে আঁকড়ে ধরেছে
চিরকাল অবিশ্বস্ত আর অবিশ্বাস্য প্রগাঢ় অন্ধকারলিপি
আতাফলের গভীর অন্ধকার থেকে মা পাখির
ডানার বিশ্বস্ত ওমে হেঁটে হেঁটে কুড়িয়ে এনেছ
ঘুমের আকর। আর একদিন অন্ধকারের ব্যথিত হৃদয়ে
বেদনায় নীল হতে হতে ক্ষয়ে গেছ হিমাঙ্কের ওপার
অরণ্যের পাতাঝরা অন্ধকারে তাই বাজপাখির ডানার
শব্দের মতো করুণ আখ্যানে বাজে তোমার জীবনী