বাতাসের অন্তিম স্ফিয়ারে
লিটল মারমেইডের গল্প এত মমতায়
লিখলেন হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এ্যান্ডারসন,
শুধু জানাতে ভুলে গেলেন
তার প্রতি মাসের রক্তক্ষরণের বেদনা…
পুরুষের চোখ দিয়ে তিনি জানতে পারেননি
কখন সমুদ্রের অতল গভীরে
শ্যাওলা ও প্রবালগন্ধী,
মুক্তো-ঝিনুকের জলরাশি লালচে হয়ে ওঠে
মাছকুমারীদের ক্ষরিত রক্ত প্রবাহে!
সে কথা লেখেননি জুল ভের্ণও…
তাঁর টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড লীগস আন্ডার দ্য সী-এর নেড
হারপুন ছুঁড়ে তিমি মেরে
সমুদ্রের নীল জল রক্তাক্ত করলেও
মাছ মেয়েদের রক্তক্ষরণের গল্প নেই সেখানে!
তারপর…কি হয়েছিল…এ্যান্ডারসন?
লিটল মারমেইড যেদিন
পৃথিবীর এক মানুষ রাজপুত্রের ভালর জন্য
ডাইনীবুড়িকে পুচ্ছ দিয়ে পেল মানুষের পা,
এ্যান্ডারসন জানেননি আর পুরুষ বলে
লজ্জায় লিটল মারমেইডও ফিসফিসিয়ে তাকে বলেনি
(যা সে আমাকে বলেছে শুধু আমি মেয়ে বলেই)
যে সার্জারি বেডেই ওর শুরু হয়েছিল প্রতি মাসের অনিবার্যতা…
যেমনটা মানুষ মেয়েদেরও অনেকেরই হয়ে থাকে…
সার্জারি বেডেও দেখা দেয় এই অমোঘতা…অনেকেরই…
লিটল মারমেইড, সমুদ্র ও পৃথিবীর কারোর না হয়ে,
বড় অকালেই যাকে চলে যেতে হলো,
যতটা বয়স হয়েছিল ওর,
ততগুলো বসন্তের অন্তত: অর্দ্ধেক
প্রবল, অকারণ রক্তক্ষরণে মাসের কয়েকটা দিন
শুধু শ্যাওলা ও প্রবালগন্ধী, মুক্তো-ঝিনুকের নীল জলরাশি
রক্তোচ্ছাসে লোহিত করে সে হারিয়ে গেছে
বাতাসের অন্তিম স্ফিয়ারে!
উত্তীয়-শ্যামা-বজ্রসেন ২০২১
মনে করো, সে বহু আগের কথা…
যতটা আগের হলে রূপকথা উপকথা বলে মনে হয়!
ওরা দু‘জন দুই বন্ধু…
অনেকটা একই রকম উচ্চতা…
বয়সও একই রকম…
তবে একজন কোমল মুখের আর একজন রুক্ষ দর্শন…
একজনকে দেখলে মনে হবে ‘বালক কিশোর উত্তীয় তার নাম‘
আর অপরজনকে দেখলেই মনে হবে শ্মশ্রু-দাড়ি-ঝাঁকড়া চুলে…
আরে ‘শ্যামা‘র বজ্রসেন কি এমনটাই দেখতে ছিল নাকি?
ও যেন কালাশনিকভ হাতে মরুতে ঘুরে বেড়ানো যোদ্ধা…
কোমল দর্শন তরুণই প্রথম পরোক্ষে বলেছিল ভাললাগা…
মেয়েটি এড়িয়ে গেছে…
আর রুক্ষদর্শনকে বোঝেইনি শুরুতে,
যেদিন প্রথম বুঝলো,
সেদিন থেকে বেশ ভাল লাগা…
বজ্রসেন অবশ্য ভাব করে মেয়েদের গণেই না…
কালে কালে দেখা গেল কোমল উত্তীয় সদৃশ ছেলেটিই রোজ কাজে যায়,
জীবনের নানা ঢেউয়ে একাধিক নারীর পাণিগ্রহন করে..
রুক্ষ বজ্রসেনের তেতো মাচিসমোয়
মেয়েরা প্রথমে খানিকটা আকর্ষিত হলেও
পরে ততটাই উল্টো বিকর্ষণে সরে আসতে হয়…
বৃথাই তার বীরত্বের ছলচাতুরি আর পৌরুষের বজ্রনির্ঘোষ,
করে না সে কোন কাজ
আর সেই ফাঁপা ব্যর্থতা মেটায় ভয়ানক গাম্ভীর্য ও পৌরুষের ভণিতায়…
মেয়েদের মানুষ মনে না করা বজ্রসেন সদৃশ লোকটি
একসময় ঘোরতর একা হয়ে পড়ে,
প্রেম দেয় নি সে কাউকেই…
অথবা দিয়েছে হয়তো…
এমন সব নারীকে যারা প্রত্যেকেই অন্য কারো
আইনসিদ্ধ সঙ্গীনী…
কেন যে তেতো বজ্রসেন এড়িয়ে গেছে জীবনভর সব
কুমারী মেয়েদের তা‘ কে জানে?
বজ্রসেনের তেতো মাচিসমোয় বিরক্ত প্রতিটি মেয়েই এখন সরে গেছে…
সবচেয়ে আহত করলো যাকে বজ্রসেন সদৃশ লোকটি
বিনা দোষে…নিরপরাধে…
যাক…বহু পরে দোষ না করেও দোষের দন্ড পাওয়া মেয়েটি
একদিন যখন সত্যিই নির্দোষ প্রমাণিত হলো,
তখন থেকে সে পাখির পালকের মত হালকা…
ইতোমধ্যে ফিরিয়ে দিয়েছে সে আরো কাউকে কাউকে
বিশ^াস ও ভালবাসায় পরিপূর্ণ ছিল যারা…
তেতো বজ্রসেন সদৃশ লোকটি এখন পীড়িত শয্যাায়,
তাকে ক্ষমা করা কঠিন…
তবু হয়তো ক্ষমা করা হবে…
উত্তীয় একাধিক পাণিগ্রহন করেও কি একা?
এই উত্তীয়কে মৃত্যুদন্ড গ্রহণ করতে হয়নি…
এই ‘শ্যামা‘-ও নয় ঠিক সেই শ্যামার গল্প
জাতকের অথবা রবীন্দ্রনাথের!
উত্তীয়কে গ্রহণ করা হয়নি সময়মত,
বজ্রসেন শুধু পদে পদে দোষ ধরেছে,
খুঁত ধরেছে আর করেছে অকারণ সন্দেহ…
পশুর মতই গোঁয়াড় ও কর্কশ ছিল সে……
এই শ্যামা নগরনটী নয়…
একুশ শতকে নগরনটী না হয়েও মেয়েরা জানে
কাজের আরো নানা পন্থা…
বজ্রসেন কি খুবই পীড়িত? কে জানে!
উত্তীয়র কোমল নিবেদন ভাল করে দেখাই হয়নি সেই কত আগে!
আর নতুন কেউ কেউ যাকে বা যাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল…
তাদের ভেতর সরলতম যে জন…
সে-ও যে কেমন আছে কে জানে?
কত দিন নেই যোগাযোগ!
কে জানে কোথায় জেগে থাকে সেই সব ছিন্ন ছিন্ন টুকরো যত রূপকথা!
উত্তীয়, তোমার সঙ্গীত যদি না বুঝে থাকি যথাসময়ে,
তবু আজ বিলম্বিত বোঝার শুশ্রুষাই দূর থেকে
ভুলিয়ে দিক সব না বলা দূরত্ব!
শ্যামা শ্যামাতর – ২২:১৮ গ্রীনউইচ সময়
এই যে আজ প্রায় কুড়িটি বছর পরে,
উত্তীয়র কোমল মুখ শ্যামার মনে পড়ে…
একথা জেনেই যে উত্তীয়ের সাথে
আর দেখা বা যোগাযোগ সম্ভব নয়,
যতটাই বা আরো বেশি অসম্ভব বজ্রসেনের সাথে…
অবশ্য মানুষ হিসেবে…আজ বোঝে শ্যামা…
উত্তীয় মূলত: ঢের ঢের বেশি ভাল বজ্রসেনের চেয়ে,
অথচ বজ্রসেনের জন্যই
শ্যামা এই কুড়িটি বছরে ছেড়ে দিয়েছে
ষোড়শ মহাজনপদের সম্ভাব্য সব প্রেমিকের হাত…
বিনিময়ে ঘৃণা, অভিশাপ, অকারণ ক্রোধ ও
রূঢ়তা ছাড়া কিচ্ছু মেলেনি…
থাকুক না উত্তীয় তার দ্বিতীয়ার সাথে,
শ্যামা ভাবে শেষ যে সদাশয় ছেলেটির সাথেও
খুব বেশি কথা বলেনি সে,
আজ কেঁদেও পাবে না ফিরে তাকে
বর্ষার বিপুল জলভারে!
তবু ওদের সবার কথাই মনে করা যায়…
প্রথম যে উত্তীয় লজ্জারুণ মুখে
একটি ভূর্জ্জপত্রে জানিয়েছিল শংসা বাক্য
থেকে শেষ ছেলেটির কথা…
বিকট, ভয়াবহ বজ্রসেন থাকুক তার মত…
তার যত দু‘প্রহরের সঙ্গীনীদের নিয়ে!