রেজা ঘটক
পুরাতন জেলখানার মাটির নিচের গোপন সুড়ঙ্গ পথের খবর একমাত্র ভূমিপুত্র হিরোতাস ছাড়া আর কেউ জানেন না। কিন্তু সমস্যা হল দীর্ঘদিন ওই সুড়ঙ্গ পথের গোপন দরজা না খোলার কারণে এখন তা খুঁজে বের করাটা বিশাল একটা ঝামেলার কাজ। জেলখানার ঠিক কোন ঘরের কোন দরজার নীচে কতো ফুট গভীরে কোন দিকে মুখ করা ওই সুড়ঙ্গ পথের দরজা তা এখন নির্নয় করাটাও আরেকটা মস্ত বড় ঝুঁকির ব্যাপার। কারণ কাজটি করতে হবে খুব গোপনে সবার অগোচরে।
কয়েদীদের নিয়ে তেমন সমস্যা না হলেও জেলখানার যারা কর্তা হুকুমজারীর মালিক যেমন জেলার, জেল সুপার, পুলিশ, সেন্টি সবাইকে একসঙ্গে ফাঁকি দেওয়াটা চাট্টিখানি কথা নয়। কেবলমাত্র রাতের বেলায় সবাই ঘুমিয়ে পরার পর অন্ধকারে ছাড়া অমন ঝুঁকির কাজটি করার আর কোন সুযোগ নেই। জেলখানার ছোট্ট ঘরের চৌদ্দ সিকের নির্বাক বন্ধ জানালার অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভূমিপুত্র হিরোতাস ওই গোপন সুড়ঙ্গ পথে পালিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখেন।
এছাড়া পৃথিবী থেকে জেলখানা প্রথার বিলোপের জন্য একটা কঠিন আন্দোলনে নের্তৃত্ব দেবার ইচ্ছা ভূমিপুত্র হিরোতাস দীর্ঘদিন ধরে লালন করছেন। কীভাবে এই বিশাল ঘটনাকে খুব দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করা যায় নির্জন কারাগারের ছোট্ট বন্ধ ঘরের অন্ধকারে মাটিতে শুয়ে শুয়ে ভিতরে ভিতরে নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করছেন ভূমিপুত্র হিরোতাস।
বাস্তিল দুর্গ পতনের ঘটনাটি তাঁর বারবার মনে পড়ে। নয় নম্বর ঘরের তিন নম্বর দরজার তিন ফুট নিচে উল্টো দিকে নয় ফুট খুড়তে পারলে গোপন সুড়ঙ্গ পথের সন্ধান মিলতে পারে এমন একটি উপায় তিনি একবার খোয়াবে পেয়েছিলেন। কিন্তু জেলখানার মোট একশত একষাট্টিটি ঘরের ঠিক কোন ঘরটি নয় নম্বর ঘর তা কয়েদীদের কেউ ঠিক করে বলতে পারে না।
অষ্ট বাহুর এই অতি পুরাতন জেলখানার প্রত্যেক সারিতেই কুঁড়িটি করে ঘর আছে। কোন বাহু দিয়ে গণনা শুরু করে কোন বাহুতে গিয়ে নবম ঘর হবে সেটি প্রায় সবারই গুলিয়ে ফেলার কথা। তবু হিসাবটি ঠিকঠাক মিলাতে পারলে গোপন সুড়ঙ্গ পথটি বের করার একটা চেষ্টা করা যাবে।
তাই ভূমিপুত্র হিরোতাস রোজ অষ্ট বাহু বরাবর নানান বিচিত্র সব অংক কষে কষে গবেষণা করে ক্লান্ত হয়ে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েন। কিন্তু সুড়ঙ্গ পথটির নিশানা তাঁর মাথা থেকে কিছুতেই যায় না। ঘুম থেকে জেগে উঠলেই আবার ওই গোপন সুড়ঙ্গ পথের অনুসন্ধান তাঁর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে।
জেলখানার বন্ধ ঘরের অন্ধ কুঠরিতে শুয়ে বসে ভূমিপুত্র হিরোতাস সুড়ঙ্গ পথ নিয়ে এই গবেষণার কাজটি এতো বেশি মনোযোগ দিয়ে করেন যে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস সুড়ঙ্গ পথটি আবিস্কার হলে তাঁর স্বপ্ন সেদিন পূরণ হবে। আর ঠিক ঠাক তাঁর স্বপ্নের আন্দোলনটি পরিচালনা করতে পারলে পৃথিবী থেকেই মানব সন্তান আটকে রাখার এই আদিম নরক জীবন্ত কবরের মতো জেলখানার প্রচলনটি চিরতরে বন্ধ হবে।
বহিঃ শত্রুর আক্রমণে রাজদুর্গ আক্রান্ত হলে শত্রুর হাতে ধরা না পরে গোপন ওই সুড়ঙ্গ পথে নিরাপদে যাতে রাজপ্রাসাদের লোকজন পালিয়ে যেতে পারে সেজন্য দুর্গ বানানোর কাজ শেষ হলে একদল মাটি কাটা শ্রমিক দিয়ে ওই সুড়ঙ্গটি তখন নির্মাণ করা হয়েছিল।
আর সুরঙ্গ খননের পুরো কাজটি তৎকালীন বাংলার সুবেদার ইসলাম কুলি খাঁর সরাসরি তত্ত্বাবধানেই সম্পাদিত হয়েছিল।
এই রকম সুড়ঙ্গ আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন হোয়াইট হাউজেও রয়েছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে হামলার সময় ফার্স্ট লেডি লরা বুশ এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনী ওই সুড়ঙ্গ পথেই হোয়াইট হাউজ ছেড়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
রাজ পরিবারের সদস্যদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এমন সুড়ঙ্গ পথ পৃথিবীর প্রায় সব দেশের রাজবাড়ির সঙ্গেই আছে। বুড়িগঙ্গার কাছাকাছি অতি আদি ওই সুড়ঙ্গ পথটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে নির্মাণ শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরি প্রদাণের পর স্বয়ং রাজার নির্দেশে তাদের সবার তখন চক্ষু উৎপাটন করা হয়।
কারণ, ওই মাটি কাটা শ্রমিক দলটি ছাড়া ওই গোপন সুড়ঙ্গ পথটির খবর গোটা রাজপ্রাসাদেই মাত্র কয়েকজন জানতেন। শত্রু পক্ষের কেউ যাতে শ্রমিকদের মাধ্যমে গোপন ওই সুড়ঙ্গ পথটির কোন হদিস করতে না পারে সেজন্যই ওই শ্রমিকদের ওভাবে তখন নির্মম নির্দয়ভাবে চক্ষু উৎপাটন করা হয়েছিল।
রাজার যুক্তি ছিল রাজপ্রাসাদ আর রাজার জীবন মরণের প্রশ্নে মাত্র আঠারোজন শ্রমিকের ছত্রিশটি চক্ষু খুবই নগন্য ব্যাপার। যেখানে হাজার হাজার সৈন্য রাজ্য রক্ষায় যে কোন সময় প্রাণ দিতে প্রস্তুত সেখানে মাত্র আঠরো জন মাটিকাটা শ্রমিক তাদের তুলনায় রাষ্ট্রের প্রয়োজনের কাছে সামান্য বিষয় ছাড়া আর কিছু নয়।
গোটা রাজপ্রাসাদেই অমন গুরুত্বপূর্ণ একটা সুড়ঙ্গ পথের খবরটি এক সময় ধীরে ধীরে ধামাচাপা পরে যায়। কারণ, রাজপ্রাসাদে নতুন আসা বাসিন্দাদের দেখভাল করার জন্য সৈন্য সামন্তরা তখন ভীষণ ব্যস্ত হয়ে যায়। দুর্গের ভেতরেই একে একে গড়ে তোলা হয় বৈঠকখানা, সৈন্যদের আবাসিক ঘর, হাতী আর ঘোড়া রাখার জন্য আস্তাবল। রাজকন্যার বৈকালিক ভ্রমণের জন্য জলাশয় কাম বাগিচা, রাজ দরবারের সদস্যদের প্রমোদ ও বিনোদনের জন্য সান্ধ্যকালীন ডলচ হাউজ বা জলসা ঘর, পরিচারিকাদের শোবার ঘর ইত্যাদি।
বুড়িগঙ্গা নদী তীরের পুরাতন ওই রাজদুর্গটি তখন এই অঞ্চলের মানুষের কাছে এক অতি আশ্চার্য ঘটনা ছিল। একসময় দুর্গটি তাদের কাছে রাজবাড়ি নামে পরিচিতি পায়। যুগে যুগে রাজবাড়ির কাণ্ড-কারখানা সাধারণ মানুষের কাছে সব সময়ই উপভোগ্য একটা বিষয় ছিল। তাদের পোষাক আশাক, খাদ্য খাবার, জীবন স্টাইল, খামাখা সব আজগুবি ব্যাপার স্যাপার দেখে দেখে ঢাকার তখনকার মানুষজন ধীরে ধীরে ধাতস্থ হয়ে যায়। দিনে দিনে তারাও বেমালুম ভুলে যায় ওই আঠারো জন মাটিকাটা শ্রমিকদের চোখ হারানোর নির্মম ঘটনাগুলো।
রাজা যায় রাজা আসে। রাজপ্রাসাদের ঘটনাবলী রাজ দরবারের নিয়মানুযায়ী চলতে থাকে। যদিও সুবেদার ইসলাম খাঁ আবাসিকভাবে বসবাস করতেন আহসান মঞ্জিলে। আর অফিসিয়াল কাজ কারবার বা শাষণ কার্য পরিচালনা করতেন এই দুর্গে বসে। আর সৈন্যদের প্রধান অংশটি এই রাজদুর্গের নিরাপত্তায় সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন।
দাক্ষিণাত্য রক্ষায় নের্তৃত্ব দেবার জন্য ঠিক সতের বছর পর কাবুল থেকে যখন ইসলাম খাঁর ডাক পরল, সুবেদার ইসলাম খাঁর সঙ্গে তার অনেক বিশস্ত সৈন্য সামন্তরাও তখন ঢাকা ত্যাগ করল। ফলে রাজদুর্গটি পরবর্তিতে কেবল সৈন্যদের আবাসিক ব্যারাক হিসেবে আর আস্তাবল হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকল।
ঠিক ষাট বছরের মাথায় যখন রাজা ধর্ম পালের কাছে বাংলায় কাবুল শাষণের অবসান ঘটল তখন এই দুর্গটি পরিনত হল যুদ্ধে হেরে যাওয়া কাবুল সৈন্যদের জেলখানা হিসেবে। পরাজিত কাবুল সৈন্যদের এখানে আটকে রাখা হল। জনশ্রুতি রয়েছে যে এক সময় এই দুর্গে আটক সৈন্যদের নতুন শাষক খাবার বন্ধ করে দেন এবং খাদ্যভাবে একে একে সকল সৈন্য মারা গেলে এই দুর্গটি শেষ পর্যন্ত একটা পরিত্যক্ত আস্তাবলে পরিনত হয়। আর দুর্গের ওই গোপন সুড়ঙ্গ পথটির খবর এই নয়া শাষকের কাছেও অজানা থেকে যায়।
কিন্তু দুর্গের এই গোপন সুড়ঙ্গ পথটির নকশা ভূমিপুত্র হিরোতাস খোয়াবে পান। জেলখানায় প্রবেশের পর হিরোতাস এই সুড়ঙ্গ পথটি আবিস্কার করার জন্য একা একা প্রচুর গবেষণা ও অনুসন্ধান চালান।
দেশদ্রোহীর অপরাধে সপ্তমবারে যখন হিরোতাসের যাবজ্জীবন জেল হয় তখন এই দুর্গে হিরোতাস তার গোপন মিশনটিও খুব গোপনে আবার শুরু করেন। আর গোপন সুড়ঙ্গ পথটির অনুসন্ধান করাটা তাঁর নিয়মিত কাজের অংশ হয়ে যায়। এমনিতে জেলখানায় রাজবন্দীদের কেবল তিনবেলা খাবারের সময় আর কোন সাক্ষাতপ্রার্থীর সাক্ষাৎ আবেদন থাকলেই কেবল ডাক পড়ে।
ভূমিপুত্র হিরোতাসের তেমন কোন সাক্ষাৎপ্রার্থী না থাকায় খাবারের তিনবেলা ছাড়া বাকি সময়টা হিরোতাস সারা দুর্গে ওই গোপন সুড়ঙ্গ পথ আবিস্কারে ব্যয় করতে থাকেন। দীর্ঘ চল্লিশ মাস টানা অভিযানের পর অবশেষে ভূমিপুত্র হিরোতাস ওই গোপন সুড়ঙ্গ পথটির এক রহস্যময় সন্ধান পান। আর সেই দিনই হিরোতাস ঠিক করেন এবার চূড়ান্ত পরিকল্পনা অনুযায়ী ঠিকঠাক কাজে নেমে পরার সময়।
ওদিকে নেতৃত্ব গুণে হিরোতাস ধীরে ধীরে জেলখানায় বন্দী প্রায় সকল কয়েদীর মন জয় করতে সক্ষম হন। দিনেদিনে হিরোতাস তাঁর অনুসারীদের যা বলেন তাই যেন জেলখানায় অলিখিত আইনে পরিনত হয়। এভাবে ধীরে ধীরে গোটা জেলখানায় ভূমিপুত্র হিরোতাস একক নেতা বনে যান।
ধর্ম বিষয়ে ভূমিপুত্র হিরোতাসের দৃষ্টিভঙ্গিগুলো যখন তাঁর বিরুদ্ধবাদীদের মধ্যে প্রথম দিকে গুজব আকারে গোটা জেলখানায় ছড়াচ্ছিল তখন ধর্মের পক্ষে যাদের এসবের প্রতিবাদ করার কথা সেই সহজ সরল কয়েদীরা পর্যন্ত ভূমিপুত্র হিরোতাসের মুখের কথা শুনে একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেত।
ধীরে ধীরে কয়েদিদের মধ্যে এমন ধারণা হতে থাকল যে ভূমিপুত্র হিরোতাস আসলে স্বয়ং ঈশ্বর প্রেরিত এক মহাপুরুষ যার অবস্থান জেলখানায় হলেও আসলে উনি একজন ধর্ম প্রবক্তা। আর ওনার প্রচারিত ধর্মের সুনির্দিষ্ট কোন নাম না থাকলেও সবার মধ্যে এটাই জনপ্রিয়তা পেতে থাকল যে মানব ইচ্ছাই আসল ধর্ম। আর সেই ইচ্ছা প্রতিপালনে মানব কর্মই তার গতি প্রকৃতি ঠিক করে।
এখানে কোন সুনির্দিষ্ট ধর্মীয় নিয়ম কানুন নেই। যে ব্যক্তি যেরূপ কর্ম পরিকল্পনা ঠিক করেন তার ধর্মও সেই প্রকৃতির হয়। যতো ব্যক্তি ততো ধর্ম। কর্মই ওই ধর্মের মূল সুর। ভালো কর্ম সুধর্মের নির্দেশক আর খারাপ কর্ম কুধর্মের পরিচায়ক। আর এসবের উর্ধ্বে তখন স্বয়ং ভূমিপুত্র হিরোতাস। পুরান ঢাকার জেলখানার তিনি তখন এক অবিসংবাদিত নেতা একজন নয়া ধর্মগুরু।
১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের প্রায় সকল নের্তৃত্ব জেলখানা থেকেই হয়েছিল। আমেরিকান বিপ্লব, ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, কিউবান বিপ্লব, ভিয়েতনাম বিপ্লব, চীন বিপ্লব, তুর্কি বিপ্লব, ইরান বিপ্লব, স্পেনের গৃহ যুদ্ধ, আমেরিকার গৃহ যুদ্ধ, পাক-ভারত যুদ্ধ, ভারত-চীন যুদ্ধ, চীন-জাপান যুদ্ধ, কোরিয়া যুদ্ধ, জার্মান-ফ্রান্স যুদ্ধ, গ্রিক যুদ্ধ, রোম যুদ্ধ, কারগিল যুদ্ধ, ইরাক-ইরান যুদ্ধ, আফগান যুদ্ধ, বসনিয়া যুদ্ধ, ইরাক-আমেরিকা যুদ্ধ, প্যালেস্টাইন-ইসরাইল যুদ্ধ, আরব যুদ্ধ সহ বর্তমান বিশ্বের প্রায় সকল জাতিগত দাঙ্গা ও যুদ্ধের ওপর ব্যাপক পড়াশুনা করে ভূমিপুত্র হিরোতাস অবসর সময় কাটাতেন।
পুরান ঢাকার জেলখানায় শুয়ে বসে তিনি একটা স্বপ্ন দেখেন। কীভাবে পৃথিবী থেকে যুদ্ধ দূর করা যায় তার উপায় বের করার জন্য দিন রাত চিন্তা ভাবনা করেন। কিন্তু নিজে জেলখানায় থাকায় সকল সংবাদ কখনো কখনো তাঁর কাছে পৌঁছায় না। তখন তিনি তাঁর অনুসারীদের কাছে অন্য সব সংবাদ শুনতে চান। ভূমিপুত্র হিরোতাস মনে করেন যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য সারা পৃথিবীতে আরেকটা মহাযুদ্ধ ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। যে যুদ্ধের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে পৃথিবীতে একজন মানুষ কখনো আরেকজন মানুষকে হত্যা করতে পারে না। একজন মানুষ কখনো আরেকজন মানুষকে জেলখানায় বন্দী করতে পারে না।
মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য সারা পৃথিবীতে কোন রাষ্ট্রীয় সীমা থাকতে পারে না। রাষ্ট্রীয় সীমা থাকার অর্থ হল এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সম্পদ বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। পৃথিবীর মানুষের পৃথিবীর কোথাও ভ্রমণের জন্য কোন ভিসা সিস্টেম থাকতে পারে না। রাষ্ট্র কাঠামো, ভিসা সিস্টেম, সম্পদ লুণ্ঠন, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, যুদ্ধ সবকিছুর মূলে রয়েছে মানুষের মধ্যে মানুষের শ্রেনীবিভাগ।
পৃথিবীতে মানুষ কখনো অন্য একজন মানুষ থেকে আলাদা কিছু নয়। একজন মানুষের যে অধিকার পৃথিবীতে রয়েছে, পৃথিবীর উপকণ্ঠে অন্য সকল মানুষেরও একই এবং সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আরেকটা যুদ্ধ বড়োই প্রয়োজন। পৃথিবীর মানুষকে একই পৃথিবীর অন্য মানুষ বা গুটি কয়েক শাসক শ্রেনী শাসন করতে পারে না। মানুষ সবাই সমান অধিকার পাবার জন্য পৃথিবীতে জন্মগ্রহন করেছে। আর ভূমিপুত্র হিরোতাস স্বপ্ন দেখেন পৃথিবীতে তিনি একটি নতুন পৃথিবী গড়ার প্রাথমিক কাজটি করবেন জেলখানায় এক ঐতিহাসিক বিপ্লব ঘটিয়ে।
কারাগারে একজন কয়েদীর আরেকজন কয়েদীর সঙ্গে কেবল বাথরুম ব্যবহার করার সময়, খাবার নেবার সময়, গোসল করার সময় আর প্রার্থণা করার সময় দেখা হয়। একই ধরণের সেলে যারা আছেন তাদের একই সময়ে ওই কাজগুলো রোজ একসাথে করার নিয়ম।
জেলখানার আরেকটা ব্যাপার হল পুলিশ আর সরকারি লোক ছাড়া বাকী সকল কাজ কয়েদীরাই করে থাকেন। যেমন কয়েদীদের জামাকাপড় বানান কয়েদীরাই। যারা এই দায়িত্ব পান তারা সবাই সাধারণত পুরাতন কয়েদী। তারা সবাই অনেকটা প্রফেশনাল টেইলারদের মতো অন্য সকল কয়েদীদের জন্য জামাকাপড় খুব সুন্দর করে বানান। টেইলার কয়েদীদের কাজ শুধু জামাকাপড় বানানো।
কয়েদীদের খাবার আবার অন্য একদল কয়েদীরাই বানিয়ে থাকেন। পুরানো কয়েদীদের অনেকের মধ্যে যারা রান্নাবান্না করায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন তারা বাবুর্চি হবার যোগ্যতা লাভ করেন। জেলখানায় যে সকল কয়েদীরা বিশেষ এই রকম কাজ করার সুযোগ পান তাদের সাজার মেয়াদ একটা নির্দিষ্ট সময় হারে কমতে থাকে।
জেলখানায় বন্দী কয়েদীদের মধ্যে আবার কয়েক ধরণের ক্যাটাগরি আছে। হাজতী বন্দী, কয়েদী বন্দী, ডিটেন্যু বন্দী, নিরাপদ হেফাজতী বন্দী ইত্যাদি। এক এক ধরনের বন্দীদের জন্য আবার এক এক ধরনের আইন। যেমন হাজতী বন্দীদের সাথে ১৫ দিন অন্তর অন্তর ১ বার করে দেখা করার সুযোগ রয়েছে। আবার কয়েদী বন্দীদের সাথে মাসে কেবল একবার দেখা করা যায়।
অন্যদিকে ডিটেন্যু এবং নিরাপদ হেফাজতী বন্দীদের সঙ্গে দেখা করতে হলে সংশ্লিষ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও আদালতের অনুমতি প্রয়োজন হয়। যে কোন কয়েদীর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করার জন্য সর্বোচ্চ সময় মাত্র ৩০ মিনিট। যে কোন কয়েদীর সঙ্গে দেখা করার জন্য জেলার অথবা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার কাছে সুনির্দিষ্ট ফরমে আবেদন পত্র দাখিল করতে হয়। সাধারণত সংশ্লিষ্ট জেল সুপার দৈনিক ভিত্তিতে একটা রোস্টার মেইনটেন করেন। আর বিশেষ বিবেচনা ছাড়া প্রায় সকল সাক্ষাৎপ্রার্থীর জন্যই ওই আইন প্রযোজ্য।
জেলখানার এসব নিয়ম কানুনের প্রতি ভূমিপুত্র হিরোতাসের কোনো আগ্রহ নাই। কারণ অকৃতদার হিরোতাসের কাছে বিগত সাত বছরে কেউ কোনোদিন সাক্ষাৎ করতে আসেনি। ওদিকে সুড়ঙ্গ পথটি আবিস্কার করার কাজে ভূমিপুত্র হিরোতাস একুশ জন বিশ্বস্ত পুরাতন কয়েদিকে ঠিক করলেন। যারা সুযোগ পেলেই অন্ধকার রাতে পুরাতন জেলখানার ভেতরে ভূমিপুত্র হিরোতাসের খোয়াবে পাওয়া নবম ঘরটির অনুসন্ধান করেন।
অষ্টবাহুর এই পুরাতন জেলখানায় ওই একুশ জন বিশ্বস্ত কয়েদি প্রতি বাহুর নবম ও আঠারোতম ঘরগুলোতে গোপনে মিশন চালানোর প্রস্তুতি নেন। কিন্তু ভূমিপুত্র হিরোতাসের যুক্তি হল এভাবে ষোলটি ঘর খোড়াখুড়ি করতে গেলে ওদের এই গোপন মিশন রাষ্ট্র হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া সুড়ঙ্গ পথের সাথে সংযোগ রয়েছে কেবল নবম ঘরটির সাথে। হিসেবে ভুল হলে গোপন ওই মিশনের খবর রাষ্ট্রপক্ষ টের পেলেই কয়েদিদের অন্য জেলাখা্নায় বদলি করা হতে পারে, এমন যুক্তিও দেন হিরোতাস।
সেদিন ছিল কোজাগরি পূর্ণিমার রাত। বিশ্বস্ত ওই একুশ জনকে নিয়ে ভূমিপুত্র হিরোতাস রাতের খাবারের পর একটা গোপন মিটিং করলেন। প্রত্যেক বাহুর কুঁড়িটি ঘরে ঘুরে ঘুরে অনুসন্ধান করার জন্য একুশজন কয়েদিকে দায়িত্ব দেওয়া হল। তিন মাস তেরোদিনে সাত চক্কর ঘুরে একুশ জন কয়েদির প্রত্যেকে সাতটি করে ঘরে অনুসন্ধান চালালেন। কিন্তু কোনো হিসাবে নবম ঘরের সন্ধান মেলে না। বাকি থাকলো শেষ চৌদ্দটি ঘর। শেষ চৌদ্দটি ঘরে অনুসন্ধান চালাতে একুশ জন কয়েদি আবার সাত জন করে তিনটি দলে ভাগ হলেন। প্রত্যেকের একবার অনুসন্ধান শেষে ভূমিপুত্র হিরোতাসকে রিপোর্ট করার নিয়ম।
এভাবে দীর্ঘ সাড়ে চার মাস পর একুশ জন কয়েদির সকল যুক্তিতর্ক মিলিয়ে ভূমিপুত্র হিরোতাস ঠিক করলেন অষ্টবাহুর কেন্দ্রবিন্দুর খোলা ঘরটি হতে পারে খোয়াবে দেখা সেই নবম ঘর। ঠিক হল আগামী অমাবশ্যার রাতে ওই ঘরে ওরা অভিযান চালাবেন। অষ্টবাহুর সারিবদ্ধ ঘরগুলোতে মোট দুইজন করে ষোলজন নিরাপত্তাজনিত দায়িত্ব পালন করবেন। অবশিষ্ট পাঁচজন গর্ত খুড়বেন।
এবার সমস্যা যেটি হচ্ছে সেটি হল তিন নম্বর দরজা ঠিক কোনটি এটা ঠাওর করাটা একটা ঝামেলার। ভূমিপুত্র হিরোতাসের নির্দেশে ওরা পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ মোট চারটি দরজাকে বেইস করে অবশিষ্ট চারটি দরজা থেকে তিনফুট দূরে তিনটি দাগ টেনে পরপর চারটি দরজার সামনে গর্ত খুড়তে শুরু করলেন। তিন ফুট গভীর গর্ত খোড়ার পর নয় ফুট উল্টো দিকে গর্ত খুড়ে অগ্রসর হলেন। না কোনো সুড়ঙ্গের দেখা মিললো না। এবার অবশিষ্ট চারটি দরজার মধ্যে দক্ষিণ দিকের দরজা ছাড়া বাকি তিনটি দরজা থেকে তিন ফুট দূরে তিন ফুট গভীর গর্ত করে নয় ফুট অগ্রসর হলেন। না কোনো সুড়ঙ্গের দেখা নাই।
ভূমিপুত্র হিরোতাস চোখ বন্ধ করে বললেন, দক্ষিণ পাশের দরজা থেকে তিন ফুট দূরে তিন ফুট গর্ত করো। তিন ফুট গর্ত খোড়ার পর নয় ফুট অগ্রসর হয়ে ওদের একজন হঠাৎ ইউরেকা ইউরেকা বলে চিৎকার করে উঠলো। সুড়ঙ্গের মুখটি একটা স্টিলের চাকতি দিয়ে ঢাকা। ততক্ষণে পুরাতন জেলখানার পাশের মসজিদে ফজরের আযান শুরু হলো। আযানের শব্দের মধ্যে একে একে ওরা একুশ জন ভূমিপুত্র হিরোতাসের পেছন পেছন সেই সুড়ঙ্গ পথে অগ্রসর হতে থাকলেন।
ইতোমধ্যে আযানের সাথে সাথে যাদের ঘুম ভেঙ্গেছে তাদের কেউ কেউ টয়লেটে সিরিয়াল না পেয়ে ওই আজব গর্ত দেখে বিস্ময় প্রকাশ করলো। কেউ কেউ ওই গর্তে উকিঝুকি দিল। কেউ কেউ টয়লেটের কাজে বিরতি দিয়ে ওই সুড়ঙ্গ পথে আগাতে ব্যস্ত হল। কৌতুহলী কয়েদিদের অনেকে আর সেদিন ভোরে নিয়মিত কাজটি করলো না। যে যেভাবে পারলো পরিমরি সেই সুড়ঙ্গ পথে অজানার উদ্দেশ্যে ছুটলো।
সূর্য ওঠার আগেই পুরাতন জেলখানায় সুড়ঙ্গ পথে কয়েদিদের বিশেষ কায়দায় পালিয়ে যাবার খবর রাষ্ট্র হয়ে গেল। কিন্তু আশ্চার্যের ব্যাপার হলো রাষ্ট্রের কোনো দায়িত্বশীল নিরাপত্তা কর্মিদের কেউ ওই সুড়ঙ্গ পথে যাবার দুঃসাহস করলো না। সেদিন মর্নিং রোল কলে মোট তিনশো তের জনকে আর পাওয়া গেল না।
সেদিন দুপুরেই সরকার পক্ষ পুরাতন জেলখানা দ্রুত অন্যত্র সরিয়ে নেবার প্রস্তুতি গ্রহণ করলো। আর জেলখানা থেকে আর যাতে কোনো কয়েদি পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য কড়া প্রহরা বসানো হল। জনশ্রুতি রয়েছে যে, পুরাতন জেলখানা থেকে সকল কয়েদিকে অন্য জেলখানায় সরিয়ে নেবার পর রাষ্টীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ থেকে সেখানে খননকার্য করা হবে। কিন্তু সুড়ঙ্গ পথে পালিয়ে যাওয়া তিনশো তের জন কয়েদির কোনো খবর কেউ আর কোনোদিন পায়নি। আর ভূমিপুত্র হিরোতাসের ওই গোপন মিশনের খবরও আজ পর্যন্ত কেউ আর দিতে পারেনি।
——-
১০ জুন ২০১৭