শাহীন আখতার
আজ যে মধুপূর্ণিমা – ছাদে না গেলে জানা হতো না।
নিরিবিলি কথা বলার জন্য আমি আর ইসমত যখন ছাদে উঠে আসি তখনো অন্ধকার। সিজন শেষের কয়েকগুচ্ছ দোলনচাঁপা ন্যাড়া ঝোপ থেকে উঁকি দিচ্ছে। বাহারের চেয়ে এর সুবাসই বেশি। অতীতে ইসমত এসব জিনিস কদর করলেও এখন গা করে না। চায়ের কাপ বুকের কাছে ধরে শূন্যে তাকিয়ে থাকে। অগত্যা ওর দিকে বেতের চেয়ার এগিয়ে দিয়ে আমি দোলনায় বসে পড়ি। আবছা আলোয় এবার দুজন মুখোমুখি কিন্তু মুখে কারো কথা নেই। আমাদের এমনও সময় গেছে – মনের কথা না বললে পেটের ভাত হজম হতো না। তাতে যে ছেদ পড়েছে, সে-ও কম করে হলে প্রায় দুই দশক। এখন মনের কথা না হোক, পরের কথা তো বলতে পারি! কতক্ষণ আর ঠাটা-পড়া মানুষের মতো চুপচাপ বসে থাকা যায়! আমি জোর করে মুখে বোল ফোটাই – তোমাদের ফ্যামিলির লোকজন তো আগে উর্দুতে কথা বলতো। কবে থেকে বাংলা ধরলো?
ওদিক থেকে শুধু গলা সাফ করার মৃদু আওয়াজ আসে।
অথচ উর্দুচর্চার খবরটা ইসমতের মুখ থেকেই আমার শোনা। আশির দশকে আমরা যখন ওদের বাসায় আনাগোনা শুরু করি, ততোদিনে বাড়ির মেয়েদের হাতভর্তি কাচের চুড়ি আর বড় বোনকে ‘বাজি’ বলা – এর একমাত্র স্মারক। এ নিয়ে ও এখন কথা বলতে চায় না কেন? নাকি এ ব্যাপারে আমাকে বিশ্বাস করে না?
আমি বলি – তখনকার দিনে নাকি উর্দুতেই কথা বলতো কলকাতার সব খান্দানি বাঙালি মুসলমান। ঢাকায় আসা মাত্র নিশ্চয় বোল পাল্টে ফেলেনি?
না, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাল্টেছে। ইসমত হাসে। কিন্তু তুমি কি লেখার বিষয় খুঁজছো?
জানা বিষয় নিয়েই লিখতে পারি না! আর এ তো …
আমার কথা বলার টিমটিমে ইচ্ছাটাও তেল-ফুরোনো বাতির মতো দপ করে নিভে যায়।
ইসমত প্রায় বিশ বছর ধরে সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছে। স্ক্যানডিনেভিয়ায় পড়তে গিয়ে অসুখটা বাঁধে। শেষবার এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে গিয়ে মনে চোট পেলেও এর বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারিনি। ইসমত যখন আমাদের দিকে মৃদু হাসি ছুঁড়ে বড় দুলাভাইয়ের টয়োটা গাড়িতে উঠে বসে, আমরা তখন গা ঘেঁষাঘেঁষি করে টার্মিনালে দাঁড়িয়ে থাকি। হাঁ হয়ে দেখি ড্রাইভার ঢাউস দুটি সুটকেস বুটের ভেতর চালান দিচ্ছে আর ইসমত গা এলিয়ে দিয়েছে বড় বোনদের মাঝখানে। তখন গাড়ির জানালা দিয়ে ও যেভাবে আমাদের দিকে তাকায়, আজ মনে হয় সেখানে বিষন্নতা জড়িয়েছিল। আমি আর সাথী দিশেহারার মতো এদিক-ওদিক ঘুরে এয়ারপোর্টের দোতলার রেস্টুরেন্টে কফির অর্ডার দেই। ইসমতকে আমরা খুব ভালবাসি। ওর এই অদ্ভুত আচরণ ব্যাখ্যা করা বা এর ধিক্কার জানানোর ভাষা আমাদের নেই। চুপচাপ কফি খাচ্ছি। রানওয়েতে প্লেন নামছে, উড়ছে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে এয়ারপোর্ট ছাড়িয়ে চষা-ক্ষেত আর খানাখন্দের ওপাশে। সেদিকে তাকিয়ে আমি সাথীকে বলি – বিদেশ গেলে মানুষ বদলায় যায়। সাথী যেন এরকম একটা কিছু শোনার অপেক্ষায়ই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে – তাই বলে ইসমত বদলায় যাবে!
– দেইখো, আমরাও যাবো।
দুদিন বাদে আমাদের ডেরায় পায়ে পায়ে হাজির ইসমত। আমি আর সাথী সে সময়টায় বাপ-মা, পরিবার-পরিজনের নাগালের বাইরে; নটা-পাঁচটা চাকরি করে, পুরুষমানুষের সহায় ছাড়া একা একা ঢাকা শহরে টিকে থাকার লড়াই করছি। আমাদের কোনো বন্ধু না থাকুক, উঠতে-বসতে শত্রুর খামতি ছিল না। বারান্দার লোহার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ইসমতকে দেখে আমরা চমকে উঠি। কি চেহারা হয়েছে এই দুই দিনে! ঘরের একমাত্র চেয়ারে বসে ও আপনমনে মিটিমিটি হাসে। তাতেই আমি আর সাথী কাবু। নিজেদের চোখে ঠুলি পরা থাকলেও ঘরের দৈন্যদশা সত্যি পীড়াদায়ক। বিদেশ ফেরত যে কারো তা হাস্যকরও মনে হতে পারে। দুজন কাচুমাচু হয়ে মেঝেতে বসে থাকি। ইসমত মুখ খোলে যখন, আমাদের চোখ ছানাবড়া – বলে কি! ওর বড় দুলাভাই রাতদুপুরে দরজায় টোকা মারে? ফেরেশতার মতো মানুষ! সেদিন এয়ারপোর্টে গাড়িতে জায়গা ছিল না বলে তিনিই শুধু দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। বড়বোন দুজন তো আমাদের চিনেও চিনলেন না। ওদিকে ইসমত মৃদু হেসেই খালাস।
– ভাবছে বোধয় ফ্রি সেক্সের দেশ থেকে আসছি, ভাই-দুলাভাই বাছবিচার করি না। ইসমত আমাদের হতবাক করে আরো বলে, বড়বোন দুজন ওর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নেমেছে। ইসমতের ঘরের লাগোয়া বারান্দায় গজাল গেড়েছে, যাতে ও পাগল হয়ে বাসা ছেড়ে বেরিয়ে যায়। বুড়ো বাবা-মা তাতে শামিল হয়েছেন।
ইসমত পাগল হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়নি ঠিকই, সন্দেহের সেই চক্করে আজও ঘুরপাক খাচ্ছে। হালে এক ডাক্তার নাকি এ উপসর্গের নাম দিয়েছে ‘থট শেয়ারিং’। ওকে নিয়ে কে কি ভাবছে, মুখ ফুটে না বললেও, ইসমত মনে করে – কথাটা ও ঠিক শুনতে পায়।
আমি অস্বস্তিতে উসখুস করি। বেতালে দোলে দোলনাটা। এখন যদিও আমার মুখে কুলুপ আঁটা, ইসমত কি টের পাচ্ছে না – আমি ওকে আপদ ভাবছি!
আমি যখন দোলনা ছেড়ে উঠি উঠি করছি ঠিক তখন পাশের নির্মীয়মান ভবনের বড় বড় খাম্বার পেছন থেকে লালচে মস্তবড় চাঁদখানা উঁকি দেয়। ইসমত নড়েচড়ে বসে। মানে, যা বলার জন্য কাউকে কিছু না জানিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে, এবার চাঁদের আলোয় হয়তো বলবে।
চাঁদ আরো বড় হয়। টবের গাছ-গাছালি ডিঙিয়ে তার তীব্র আলো আমাদের চোখে-মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ে। চাঁদের তীব্র আলো! ইসমত আশির দশকের একটি গল্প বলে। আমাদেরই গল্প। সবে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। লাইব্রেরিভর্তি নানা দেশের সাহিত্যের বই, সামনে সবুজ মাথামোড়া ঘাসের লন, শানবাঁধানো গাছতলায় ফোল্ডিং চেয়ার পেতে চা-নাশতা খাওয়ার আয়োজন, তরুণ-তরুণীর মিলিত কোলাহল – ঢাকার মধ্যবিত্ত এলাকায় আগে দেখা যায়নি। আমরা খুশিতে ডগমগ। মানিক মিয়া এভেনিউ দিয়ে এক রিকশায় তিনজন ফিরছি। তখন সামনে আড়ং বা আড়ংয়ের মাথার বিজ্ঞাপনের জায়ান্ট মনিটর নেই – খোলা জায়গা। ওদিকে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। আমাদের একজন চেঁচিয়ে ওঠে – কি সুন্দর চাঁদ!
গল্পটা শেষ করে ইসমত খিলখিলিয়ে হাসে। আমি ওর হাসির সঙ্গে তাল মেলাতে হাসি। দিনের আলোয় কি সুন্দর চাঁদ – কে যেন বলেছিল? নাম শুনে রোমান্টিক এক মেয়ে ও তার আধো আধো কথা বলার ভঙ্গিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কথাগুলো মনে পড়ে না।
মনে পড়ে ইসমতদের বাড়ির চারতলার ছাদ থেকে শিয়া মসজিদের সবুজ গম্বুজের ওপর দিয়ে এক চিলতে নদী দেখা যেতো। আমাদের জীবনের অনেক বিভ্রান্তিকর সময় কেটেছে সেই ছাদের দরজা এঁটে লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট ফুঁকে আর নানা ঋতুতে নদীর বিচিত্ররূপ দেখতে দেখতে। শহরটা নদী-নালা মাড়িয়ে পাগলের মতো ছুটছে। এখন সেখানে জাপান গার্ডেন সিটির বিশাল বিশাল ম্যাচবাক্সের মতো ফ্ল্যাটবাড়ি।
- আমাদের বয়স বাড়ছে। এ দিকে পরিবর্তনগুলো ইচ্ছামাফিক হচ্ছে না।
- দেশের মতো আমার জীবনটাও খাপছাড়া, গণ্ডগোলের।
- আমার তো এখন দেশটার জন্য মায়াই হয়। আহ্ বেচারা! এর তো কোনো ভবিষ্যৎই নাই।
- যত দিন যাবে, মনে করবে আরো বাজে সময় আসছে।
- সহস্র সহস্র বছর আগে এই দিনে, গৌতম বুদ্ধকে বনের বানর মধু দান করেছিল।
অনেকক্ষণ ধরেই আমাদের কথাবার্তা চলছে। তবে সেসব কেমন ছেঁড়া ছেঁড়া। আগের মতো জমছে না। যা যায়, চিরদিনের মতোই যায়।
রাত বাড়ছে। চাঁদের আলোয় ঘড়ির কাঁটা দেখা তো যায়ই, মেঝে থেকে সূচ কুড়ানোও সম্ভব। ইসমত কোলের ওপর হাত রেখে পাথরের মতো ঠায় বসে থাকে।
- এখন ছাদে যাও না?
- ঘরেই বলে টিকতে পারি না!’
- যতই মন খারাপ লাগুক, আমরা তো আগে ঘরে বসে না থেকে ছাদে চলে যেতাম। আর জীবন নিয়ে আকাশ-কুসুম ভেবে হা-হুতাশ করতাম। কথাটা শেষ করে আমি হাসি।
- তখন তো ভাবি নাই যে, মাথার ওপর ছাদ থাকবে না।
ইসমতের কথা শুনে বুকটা কেঁপে ওঠে।
আমি চাঁদের আলোয় ভেসে ভেসে কদিন আগে ঘুরে আসা বারহাট্টার চাট্টা গ্রামে ফিরে যাই। গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে উঠোনে চকরা-বকরা আলো পড়েছে। মেয়েরা তালি বাজিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচছে আর গাইছে- তুমরা ঐ শুনো না গো/জলের ঘাটে চিকন কালা/আমায় ডাকে গো।/ও সে যে আমায় ডাকে/আমায় ডাকে গো।
-এই যে চিল্লাইয়্যা-ফাল্লাইয়্যা এইসব গান গাইতাছেন, বাড়ির পুরুষরা মাইন্ড করে না? আমার কথা শুনে মহিলারা চোখ টেপাটেপি করে- মাইন্ড-মুন্ড করে না। রাধা-কৃষ্ণের গান করবাম – দোষ কী?
– বারহাট্টার পুরুষগুলা বোকা! এই প্রথম ইসমত আশির দশকের মতো প্রাণখোলা হাসি হাসে।
– বোকা না চালাক জানি না। বইয়ের কাজে দিনে গিয়ে দিনে ফেরা। দু-চারটা গান শুনে, ফাঁকে ফাঁকে বিজ্ঞের মতো প্রশ্ন করে, তুমি কারও হাঁড়ির খবর জানতে পারবে?
– তোমার ঐ মেয়েগুলাই মনে হয় চালাক। রাধার ভেক ধরে আছে। ইসমত আগের মতো ইয়ার্কি মারে।
– ওরা বাঁচার কায়দা জানে। মাথার ওপরের ছাদটাও মনে হয় শক্তপোক্ত।
– হুঁ, গাছেরটাও খায় তলারটাও কুড়ায়।
– আমরাই বোকা। আমার গলার স্বর নিজের কাছেই নরম শোনায়।
– তালিম নিতে তাই হুটহাট গাঁয়ে চলে যাও?
– ক্ষতি কী। শহরের লোকেরা তো রাতদিন তালিম দিচ্ছে গাঁয়ের লোকদের। পায়খানা করে কীভাবে ছুঁচতে হবে। সাবান কেনার পয়সা না থাকলে, এক চিমটে ছাই – তাই দিয়ে হাত পরিষ্কার করুন।
– কে যে সভ্য আর কে যে অসভ্য! ইসমত দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিজের মায়ের পেটের ভাই। সাত বচ্ছর স্পেনে কাটিয়ে দেশে ফিরেছে। ডিভোর্সি বোনকে বলে বেশ্যা। খানকি। ঘুমের মধ্যে নাক ডাকে বলে স্বামীর ঘর থেকে চলে আসে কেউ, এক খানকি ছাড়া!
– তুমি নিজের কানে শুনেছো?
-এ এক সমস্যা। সবাই ডাক্তারের মতো জেরা করে।
– ভাই দেশে থেকে যাবে? তাহলে তো বিপদ!
আজকাল বিদেশে ফোন করা যায় সস্তায়। বাপ-মা ফোনে কান্নাকাটি করেছেÑ একমাত্র পুত্রসন্তান বিদেশ-বিভুঁই পড়ে থাকলে চলে? মরলে পর কাঁধে নেবে কে? নিজেদের চার-চারটা মেয়ে আছে ঠিকই, তারা নিজের সংসার ফেলে ছুটে ছুটে হাটবাজার করে দেয়, ডাক্তারখানা, ইলেকট্রিক-গ্যাস-পানি-ফোনের বিল পরিশোধও করে, কিন্তু কাঁধ তো দিতে পারবে না। পুত্র পত্রপাঠে চলে আসে। আসতে না আসতে বুড়ো বাপের লাঠি বাগিয়ে ছেলের সে কি লম্ফ-ঝম্ফ, বাপ-বেটায় হাতাহাতি!
ইসমত কি নিজের চোখে এসব দেখেছে? ডাক্তারের থট-শেয়ারিংয়ের মতো কান বা মনের ব্যাপার তো এ নয় যে, পুরনো বান্ধবীর চোখকেও অবিশ্বাস করবো! মনটা খারাপ হয়ে যায়। একমাসও হয়নি ভাই দেশে ফিরেছে, এর মধ্যে বিবাদ করে হেয়ার-ড্রায়ার, পারফিউম আর যা যা বোনকে উপহার দিয়েছিল, সেসব ওর ফেরত নেয়া হয়ে গেছে। বাবা-মা মারা গেলে ইসমত দাঁড়াবে কোথায়? ভাই তো গলা ধাক্কা দিয়ে এক বস্ত্রে বাসা থেকে বের করে দেবে। বোনেরা হয়তো গলাগলি করে খানিক কান্নাকাটি করলো। চাঁদের আলোয় নিজেদের ছায়া দুটিকে কেমন যেন ভূতুড়ে লাগে। আবার আমার পালাতে ইচ্ছে করে…
বাঁশঝাড়ের নিচ দিয়ে পা টিপে টিপে পানি-কাদার পিছল পথ উতরে গেলে হাতের তালুর মতো ঝকঝকে উঠান। সেখানে বাদ্য বাজে, নাচ-গান হয়- ঘাট পিছুল, পন্থ পিছুল, পিছুলিয়া মাটি গো/পিছলা ঘাটে আছাড় খাইয়্যা/ভাইঙ্গা আইলাম কলসি গো।
-তুমি আসলে পালাতে চাও। ইসমতের কথা শুনে চমকে উঠি। ও খিকখিক করে পাগলের মতো হাসে- আমি বাঘ না ভালুক?
আমাকে গম্ভীর দেখে ইসমত হাসি থামিয়ে ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত ৮টাও বাজেনি, বাসায় ফেরার প্রশ্নই ওঠে না। সাথীর ওখানে যাওয়ার কথা ভাবছে হয়তো। কাজিন সায়রার বাসার পাঠ চুকে-বুকে গেছে মনে হচ্ছে।
-সায়রা মেয়েটা আসলে কেমন? আমার কৌতূহল হয়। ওর গল্প শুনেছি অনেক, যদিও সামনা-সামনি দেখাসাক্ষাৎ হয়নি কখনও।
ভালোই – ইসমত গলা খাদে নামিয়ে বলে। তবে গাড়িছাড়া বাড়ির আত্মীয়-আশ্রিতদের গলির মুখে মোবাইলের ফ্লেক্সিলোড করতে যাওয়াও বারণ। ইসমত হচ্ছে বড়লোকের বউয়ের সাক্ষাৎ চাচাতো বোন – পায়দল গেলে বাড়ির দারোয়ানরাও বরদাস্ত করবে না। অথচ বড়লোকের সম্মানীয়া মেহমান থাকছে কিন্তু সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে একটি মাঝারি রুমে, চাকরানিদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে!
ইসমতের অবশ্য সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে থাকা নিয়ে সমস্যা ছিল না। ও বৃদ্ধা কাজের বুয়া লালচানের মাকেও বাগে এনে ফেলেছিল। দুজনের মধ্যে অলিখিত একটি চুক্তি হয়। লালচানের মা ভোররাতে লাইট জ্বালিয়ে তাহাজ্জতের নামাজ পড়বে, ইসমত নিজের ইচ্ছেমতো যখন-তখন ঘরে বসে সিগারেট ফুঁকবে, ঘরের চৌদ্দ ইঞ্চি সাদা-কালো টেলিভিশনে বাসার জোয়ান কাজের মেয়ে দুটি নাটক-সিনেমা, হিন্দি-নাচগান যখন খুশি দেখতে পারবে। এ চুক্তি মেনে ওই বাড়িতে যে থাকতে পারে- থাকবে, যে পারবে না সে চলে যাবে।
আমারও চুক্তিটা খুব পছন্দ হয়। সুস্থ থাকলে ইসমত যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর চাকরি করতো, এখন সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে থাকাটা যেন ওর সঙ্গে দিব্যি মানিয়ে গেছে। কিন্তু আখেরে ইসমতকেই তো ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে হলো। কেন? আমি রুষ্ট হয়ে বলি – ওই সায়রাটা যত অনিষ্টের মূল!
ইসমত আকাশ থেকে পড়ে। সায়রা তো চুক্তি-টুক্তির বিন্দুবিসর্গও জানে না। মেয়েটা এমনিতে খুব পরোপকারী। কোলে-পিঠে করে ছোটকালে মানুষ করেছে যে বুয়া, বৃদ্ধ বয়সে তাকে পথে বসাবে এমন পাষণ্ড ও নয়। বিছানায় বসেই বুড়ি খায়-দায়, নামাজ-কালাম পড়ে, পেসাব-পায়খানা আর গোসলের জন্য রান্নাঘরের পেছনে যে টয়লেট আছে, সেখানে তাকে ধরে ধরে নেওয়ার জন্য জোয়ান দুটি কাজের মেয়ে আর ইসমত তো রয়েছেই। লালচানের মা থাকে মহা আরামে। দেশের বাড়ি মাসের প্রথম সপ্তায় ছেলেকে তার টাকা পাঠানো চাই। যতই বড়লোক হোক মানুষের সুবিধা-অসুবিধা আছে। কচ্চিৎ সাত-আট তারিখ পেরিয়ে গেলেই মাথা গরম। মাসের হিসাবে লালচানের মায়ের কখনও ভুল হয় না। ওদিকে ফজরের নামাজ দেখা গেল দিনে দুইবার পড়ছে। বাথরুমে নিয়ে যেতে দেরী হলে তালপাতার পাঙ্খা তুলে আসমা, রোজিনার মতো ইসমতকেও বাড়ি মারে। হাতপাখার উল্লেখ চুক্তিতে নেই। ইসমত তাই সন্ত্রস্ত হয়ে বলে – আমি আসমা-রোজিনা না, মুন্নী মুন্নী! ইসমতের ডাকনাম শুনে বুড়ির স্মৃতি ফিরে আসে – ও মোজাম্মেল সাবের ছোড মাইয়্যা মুন্-নী! তুমি না বিদেশ গেছিলা, আইলা কবে? লালচানের মার হাত থেকে তালপাতার পাখা মাটিতে পড়ে যায়। টয়লেটে না গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বুড়ি বিছানায় শুয়ে পড়ে- হায় হায় আমি কি নেমকহারাম, মোজাম্মেল সাবের ছোড মাইয়ারে বাড়ি মারছি! এই হাত দুইডা কুষ্ঠু ব্যারামে পইচ্যা পড়ুক।
পরদিন আবার যে কী সেই।
– নাটের গুরু তাইলে ওই জাঁহাবাজ মহিলা লালচানের মা?
না, সেও না। আসমা বা রোজিনাও না। ওরা তো ইসমতকে পারলে মাথায় তুলে নাচে। সকাল-সন্ধ্যা টিভি দেখার এমন সুবন্দোবস্ত মুন্নী আফা ছাড়া আর কে করতে পারতো। তাহলে কি বড় দুলাভাইয়ের মতো সায়রার স্বামীর কোনো গর্হিত আচরণ, যা লোকটা হয়তো করেনি কিন্তু থট শেয়ারিংয়ের আওতায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে গেছে! আর করেও যদি থাকে অবাক হওয়ার কিছু নেই। গুলশানের হঠাৎ বড়লোক – হাতে যাদের চুরি বা তেজারতির কাঁচা টাকা, ওদের পক্ষে সবই সম্ভব। মুখে বলি – সায়রার স্বামীই মনে হচ্ছে আসল কালপিট।
ইসমত আমার সন্দেহ বাতিকে মহা বিরক্ত। নিজের কানে না শুনে, খালি আন্দাজের ওপর কারো গীবত গাওয়া যে কত খারাপ – এ নিয়ে ও লম্বা-চওড়া বক্তৃতা ঝাড়ে। আমি মরমে মরে যাই। পরমুহূর্তে ভয় হয় – রোগটা ছোঁয়াচে নাকি? দুই দশক ইসমতের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি। হালে মনে হচ্ছিল ফাঁড়া কেটে গেছে – আসলে কাটেনি। এ তো শুধু ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ব্যাপার নয়। তার আগে ঘরে আগুন লেগে যাবে।
– তোমার সংসার কেমন চলছে?
আমি ঘাড় গুঁজে নিজের বামুন আকৃতির ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। মুখে কথা নেই। ও যদি এখন – কেন সায়রার বাসা থেকে চলে এলো, এ নিয়েও কথা বলতে চায়, আমি শুনতে চাই না। যদিও আজকের গালগপ্পের মধ্যে এটিই ছিল সেরা। ইসমত মরিয়া হয়ে উঠেছে। দুহাত দিয়ে জোরে জোরে দোলনাটা দোলায় – ও কি ঘুমিয়ে পড়েছ! বলবা না – তোমার সংসার কেমন চলতেছে?
বামুন আকৃতির জমাট ছায়া ভেঙ্গেচুরে চাঁদের আলোয় দোল খায়। আমি চোখ তুলি – ইসমতকে অনেক প্রাণোচ্ছ্বল লাগছে দেখতে। ও যখন মেঘলা দিনে হলের করিডোরে দাঁড়িয়ে গান গাইতো, টিউটোরিয়াল পরীক্ষার পড়া ফেলে আমার তখন-তখনই বাইরে বেরিয়ে পড়ার ইচ্ছে হতো। পরীক্ষা পরেও দেয়া যাবে, বৃষ্টিতে ভেজার মতো আনন্দ আর কিছুতে নেই।
আশির দশকের আয়নায় চোখ রেখে আমি অস্ফুট স্বরে বলি – সংসার? এই চলছে আরকি।
ইসমতের চোখে-মুখে আঁধার নামে – চললেই ভালো। জানো তো সাথী গান শিখছে?
এ প্রশংসা না কুৎসা! ও কি বলতে চায় – আমরা ভালো থাকার ভান করছি, আসলে ভালো নেই? আয়নাটা খানখান হয়ে ভেঙ্গে পড়ে। সাথীর সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ হয় না বহুদিন। ইসমত এখনো আমাদের গত জীবনের দোরে দোরে ফিরছে অথচ ও আগের মতো নেই। আমরাও কি আছি? বছর সাত-আট আগে হঠাৎ সাথীর ফোন। ও যে প্রেগন্যান্ট, ইসমত যেন না জানে। আমি আকাশ থেকে পড়ি – যার স্বামী-বাচ্চা রয়েছে, তার মুখে এ কি কথা? ওপাশ থেকে জবাব আসে – আমাদের ভালো খবরে ইসমত খুশি হয় না। মনে হয় খুব কষ্ট পায়। রাতের বেলা গুমরে গুমরে কাঁদে।
হবে হয়তো। ইসমত তো একটা বন্ধ বই – ভেতরে কী আছে, আমরা না পড়েই যা খুশি বলতে পারি।
– তুমি গান করো না এখন?
ইসমত চেয়ারের ভেতর গুটিশুটি মেরে বিড়ালের মতো বসে থাকে। ওর গলা সাফ করার আওয়াজটা এবারও বিরক্তি প্রকাশের। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর কি পছন্দ হবে কাঙালিনী সুফিয়ার গান, যা মাস ছয়েক আগে আমি রেকর্ড করে এনেছি? একটা মালা গাঁইথা দে/প্রাণ সখিরে/মরে নাই মরে নাই বিয়ার সুয়ামি/গতকাল আইসাছে…
তেরো-চৌদ্দ বছরের নাতির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী, যে চুড়িদার পরে নানির গানের সঙ্গে জিপসি বাজাতো। বাদআসর মিলাদ শেষে দক্ষিণের জানালা খুলে খঞ্জনি হাতে বসলেন কাঙালিনী। সেখান থেকে খুব কাছেই বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, যার একটি খাম্বার তারে জড়িয়ে নাতিটা মারা যায়। কাঙালিনী সুফিয়া একের পর এক গান গাইছেন। তার গলা দিয়ে বিলাপ উঠে আসছে।
- গান করো না কেন আগের মতো? গানে ডুব দিয়ে জিন্দেগির দুঃখ-কষ্ট ভুলে থাকা যায়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ইসমতকে আমি উপদেশ দিই।
- আমি খবরের কাগজও পড়ি না।
- খবর-টবর সব বল্গাহীন ছুটছে। দেশের পরিস্থিতি জরুরি অবস্থার চেয়েও খারাপ।
- দেশে ধর্ষণ নাই, এসিড মারা নাই, হোমিসাইড- কিচ্ছু নাই। রাস্তার ছেলেগুলোও মনে হয় মেয়েদের বিরক্ত করতে ভুলে গেছে। পরিস্থিতি শান্তি-শৃঙ্খলা বাহিনীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে।
ইসমতের বিবৃতিটা রাতের খাবার খেতে খেতে বাসার সবাই উপভোগ করে। খোদার কাছে হাজার শোকর – পাগল হইলেও মেয়েটা কথা বলে দারুন আর মাথাটাও দিব্যি পরিষ্কার।
ঘরের বগলের মসজিদে তারাবির নামাজ তখনো শেষ হয় নাই। জ্যোৎস্না রাত বলেই হয়তো ঠিক করি – হাঁটাও হবে, ইসমতকে বড় রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি। নিজেদের ছায়া দেখতে দেখতে সুনসান গলিতে হাঁটছি আর ওর কথা শুনছি। রাত দশটাও বাজেনি, বাসায় গিয়ে তোপের মুখে পড়তে হবে। দেখো, আমার বয়স পয়তাল্লিশ, তোমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে – রাত দশটা পর্যন্ত আমি কোথায় কার কাছে ছিলাম? আমার ছায়ার দিকে ইসমতের তর্জনী তোলা দেখে দাঁড়িয়ে পড়ি। আচ্ছা পাগল তো! খানিকটা এগিয়ে ও আবার আমাকে রাস্তার মাঝখানে দাঁড় করায় – আমরা নাকি টাইম মেশিনে করে পেছনে যাচ্ছি, যখন হলের বাইরে বেরোতেও হাউজ টিউটর বা বাপ-মায়ের পারমিশন লাগতো। এভাবে দাঁড়িয়ে পড়ে আবার হেঁটে, দুটি বাঁক ঘুরতেই আমাদের মিনিট পনেরো লাগে।
ঈদের বাজার। রাস্তার পাশের শপিং মলে বিস্তর আলোকসজ্জা হয়েছে। সুসজ্জিত নারী-পুরুষ, রিকশা-গাড়ির হুটোপুটি। আরে এ তো অন্য জগৎ! এখন কারো মার্কেটে যাওয়া লাগে না, ঘরের দুয়ারে সব চলে এসেছে। আমার গায়ে ঘরে-পরার কাপড়। আর ইসমত পরে আছে আশির দশকের জোব্বাজাব্বা। আমগাছের তলার আলো-আঁধারে আমরা গা-ঢাকা দিয়ে দাঁড়াই। ওকে রিকশায় তুলে দিয়ে অতিসত্বর কেটে পড়বো। দুজন আরোহীসমেত একটি মোটরবাইক গায়ের ওপর পড়তে পড়তে সুড়ৎ করে বেরিয়ে যায়। আমি ওর হাত চেপে ধরি – দেখলা, কী বললো?
– না-তো! কী বলেছে? ইসমত আমার দিকে অবাক হয়ে তাকায়।
– আমরা ওদের সঙ্গে যাবো কি না, জিগ্যাস করছে।
– আমাদের বোধ হয় রাস্তার মিসকিন ভেবেছে।
– না ফ্লোটিং বেশ্যা! মেয়ে হান্টিংয়ে বেরিয়েছে রাস্কেলগুলা।
বাসায় এসে ঘটনাটা বলতেই শ্রোতার চক্ষু চড়কগাছ – তুমি নিজের কানে শুনছো?
কি মুশকিল! সবাই ডাক্তারের মতো জেরা করে!
অক্টোবর–নভেম্বর ২০০৭
Definitely, what a great blog and revealing posts, I definitely will bookmark your site. Best Regards!
I got what you intend,bookmarked, very decent website.