মাহবুব আজীজ
আবদুল মোতালিবের বয়স ১৭ কি ১৮ এই বয়সে আর যাই হোক, মৃত্যুচিন্তা হওয়ার কথা নয়; আবদুল মোতালিবের তাই হয়; সে জীবনের অর্থহীনতা নিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিজের সম্ভাব্য মৃত্যু নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ে।
আমরা, বাদিহাটির যুবকেরা বিষয়টিকে শুরুতে হাসি-ঠাট্টার বলে ধরে নিই, আবদুল মোতালিব আমাদের বন্ধুবৃত্তের কনিষ্ঠ ঘরানার, সরাসরি বন্ধু সে আমাদের নয়-তবে গ্রামদেশে যা হয়, ২/৫ বছরের ছোটদের স্নেহের চোখে দেখি আমরা, মোতালিবের ক্ষেত্রেও তাই- ছেলেটা কামেকাজে মনোযোগী নয়, ইশকুলে তিন/চার ক্লাস পর্যন্ত পড়েই ইস্তফা দেয়- প্রাথমিক স্কুলের পাঠও তার নাই, এরপর সে এই বাড়ি ওবাড়ি ফুটফরমাস করে ফেরে! তার পিতা আবদুর রশিদ পাঁচ মাস আগে জৈষ্ঠ্য মাসে আকষ্মিক এক ভোরে বুক ব্যথায় মরে যায়, তার বড় দুই বোন রাহিদা আর শাহিদাই তার মুরুব্বি। রাহিদার বিয়ে হয় বছর ছয়েক আগে, জামাই ভাদাইমা, যাকে বলে ভ্যাগাবন্ড- দুই বছরের পুত্র সন্তানসমেত রাহিদা বাদিহাটিতে বাপের ভিটায় ফিরে আসে, শাহিদা পার্শ্ববর্তী কাউয়ানাড়া গ্রামে বছর কয়েক আগে গড়ে ওঠা দিয়াশলাই ফ্যাক্টরিতে মাসভিত্তিক বেতনে কাজ নেয়; তাদের মা জীবিত, একসময় মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করলেও , এখন আর করে না; ছোট আরেকটা ভাই জুবায়ের মাদ্রাসায় চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। রাহিদা আর শাহিদার ভাষ্যমতে তাদের ভাইয়ের বয়স ১৩/১৪ পাড় হয় নাই- আমরা এলাকার যুবকেরা অবশ্য জানি, মোতালিবের বয়স কমপক্ষে ১৮ তো হবেই!
গ্রামদেশে ছেলেমেয়েদের বয়সের গাছপাথর থাকে না; তাই এই নিয়ে আমরা না ভাবলেও মোতালিবের মৃত্যুচিন্তার রহস্যের কিনারা আমরা করতে পারি না।
রাহিদা-শাহিদা-মোতালিব আর জুবায়েরের পিতা আবদুর রশিদ কাজে কর্মে মোতালিবের চেয়েও চিরকাল অমনোযোগী ও ফাঁকিবাজ ছিল। আমরা শুনেছি, যৌবনকালে যাত্রাপালার দিকে তার বিশেষ মন যায়, রীতিমতো সরিষাবাড়ি গিয়ে আবদুর রশিদ যাত্রাদলে নাম লেখায়, শীত সিজনে ‘মাইকেল মধুসুদন’ কি ‘মৌচাকে মধু’ যাত্রাপালায় বিবেকের পাঠও গায়; তা দিয়ে সংসার সেভাবে না চললেও সেদিকে তার মনোযোগ থাকে না; কালে চারখানা পুত্রকন্যা নিয়ে বাদিহাটির নামী আড়তদার নিজাম সরকারের বাড়ির এককোণে ঠাঁই হয় তার। দেড়খানা ঘরে পুত্রকন্যাসমেত আবদুর রশিদকে থাকতে দেয় নিজাম সরকার। বানাড় নদীর তীরে গড়ে ওঠা ইটভাটায় মাঝেমধ্যে দিনমজুরি, আর কন্যারা এর ওর বাড়িতে কাজ করে যে সামান্য আয় – এই দিয়েই আবদুর রশিদের দিন কাটতো শেষের দিকে, গত জৈষ্ঠ্য মাসের ভোরে প্রচন্ড বুকে ব্যথা তাকে সকল দায় থেকে মুক্তি দেয়।
এরমধ্যে আবদুল মোতালিবকে মৃত্যুচিন্তা পেয়ে বসে।
‘ক্যান বাহে! মরবার চাও ক্যান বাহে!’ আমরা আবদুল মোতালিবকে জিজ্ঞেস করি।
‘ মুই মরবার চাই না। কিন্তুক আমার মৃত্যু সন্নিকট। মরবার পর কি হয়?’ আবদুল মোতালিব স্থিরকণ্ঠে আমাদের জিজ্ঞেস করে।
আমরা হাসি, পাগল হলো নাকি ছেলে- জোয়ান বয়স, কামেকাজে টইটই করে ঘুরবে বা আমাদের মতো আড্ডা দেবে বানাড় নদীর পাড়ে কি পলাশীহাটা ইশকুলের উল্কেল্টাদিকে; তা’ না; মরবার পর কি হয়! শুরুতে মোতালিবের কথার কেউ গুরত্ব দেয় না; কিন্তু দিনে দিনে বিষয়টা গুরুতর আকার ধারণ করে: রাতে ঘুমের ভেতর ভয় পেতে শুরু করে মোতালিব-গভীর রাতে তার চিৎকারে পাড়া প্রতিবেশির ঘুম ভাংগে- মইরা যামো। মইরা যামো আমি! মরবার পরে কি হয়!…
‘অই ভাদাইমা! তুই একলাই মরবি। দুনিয়ার বেবাক মানুষ মরছে, মরতাছে আর মরবো! তুই একলা একলা ডরাছ ক্যারে!’- মোতালিবের পরিবারের আশ্রয়দাতা নিজাম সরকার বিপন্ন যুবককে বোঝানোর চেষ্টা করে।
রাশিদা আর শাহিদা কেঁদে পড়ে পলাশীহাটা মসজিদের ইমাম সাহেব মাওলানা কুদরত আলী ব্যাপারির কাছে- ‘আমরার ভাইরে বাঁচান! জ্বীনে ধরছে মনে লয়! খালি মরা মরা করতাছে!’
‘তুমরার ভাইরে কুনোদিন মসজিদে দেখি না। জুম্মার নমাজটা পর্যন্ত পড়ে না। এহন মওতের ভয় পাইতাছে! এর নাম আল্লার বিচার!’
‘তাইলে কী করণ যায় আমরার ভাইয়ের লাইগা?’ -হুজুরের কাছে নিদান চায় শাহিদা; বাপ মরার পর পরিবারটিকে সে-ই টেনে নিয়ে চলে; এরমধ্যে এই বিপদ; জোয়ান ভাইটা মৃগী রোগীর মতো; মইরা যামো, মইরা যামো বলে আতকা অজ্ঞানের মতো হয়ে যায়, মুখে ফেনা ভাঙ্গে।
‘কুদরত হুজুরের কাম এইটা নয়ায়; কাউয়ানাড়া গেরামের লতিফ মুন্সি জ্বীন তাড়ানোয় ওস্তাদ। হেরে শুক্রবার ডাক দাও। দুইটা ঝারা দিক। মিত্যুচিন্তা পলানোর জায়গা পাবো নারে!’- বাদিহাটির প্রবীণ মুরুব্বী শরাফত মৃধা এই চিকিৎসা দেয়। রাহিদা আর শাহিদা জানে, জ্বীন তাড়ানো মানে জম্মের পিটান দেবে আদরের ভাইকে; তারা দ্রুত আচল দিয়ে আড়াল করে মোতালিবকে- ‘নাগো। ভাই আমার এমনিই একটু উল্টাসিধা কথা কইতেছে। পাঁচমাস আগে বাপ মরছেতো! তাই! কাল থিকা পাচ ওয়াক্ত নমাচ পড়তে পাঠামু পলাশীহাটা মসজিদে, কুদরত হুজুরের কাছে কোরআন শরীফ পাঠ নিবে; দেইখবেন আপনেরা ভাই আমার ঠিক হয়া যাবে।’
আপাতত তাই সাব্যস্ট হয়।
ভোরের অস্ফুট আলোয় দেখা যায় আবদুল মোতালিব পায়জামা-পাঞ্জাবি পড়ে মসজিদে যায়। ফজরের নামাজ শেষে তার সারম্ভর উচ্চারণে আরবী হরফ শেখার আওয়াজ পাওয়া যায়। দিনের অন্য চার ওয়াক্তও সে মন দিয়েই পড়তে থাকে! তবে সপ্টাহখানেক মাত্র; তারপর আবার সেই ঘনরাত-রাতঘুমের মাঝখানে মোতালিবের তাড়স্টর চিৎকার : মইরা যামো, মইরা যামো, মরবার পর কি হয়!
এরপরের ধাপে মাওলানা কুদরত তাকে জীবন ও মৃত্যু বিষয়ে তার জানা যাবতীয় জ্ঞান বিতরণের চেষ্টা করে। মৃত্যুর পর পহৃণ্যবান ঈমানদারদের জন্য রয়েছে অনন্ত আনন্দের জীবন, রোজ কেয়ামতে নির্ধারণ হবে কৃতকর্মের ফলাফল! এই দুনিয়ার কর্মকৃতি সবকিছুর পাইদানা হিসাব করে প্রত্যেকের বেহশত আর দোজখ নির্ধারণ করবেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন।
মোতালিব শোনে; কয়েকদিন চুপ থাকে; এরপর সে হুজুরকে জিজ্ঞেস করে বসে, ‘বেহেশতে অতো আমোদে থাকলেও আমার লাভ কি! আমার আমোদতো আমি নিজের কাউরে দেখাইতে পারবো না বা হেগোরে সাথে নিয়া আমোদ করতে পারুম না। মনে করেন যে, আমার বইনেরা, ভাইগনা বা আপনে হুজুর- এতো এতো মাইনষের ভিড়ে আপনেরা কুন্ না কুন্ বেহশত বা দুজখে থাকলেন; আমি বিছড়াই পাইবাম কেমনে!…আর রোজ হাশর হইবো সেই কবে! অদ্দিন আমি কই থাকাম!…কব্বরে! যেমনে বানাড় নদী ভাংগতাছে, বাপের কব্বরটা পাঁচ মাস টেকে না; আমারটা কই ভাসি যাবে। তাইলে…তাইলে আমার মরবার পর কি হইবো!’
কুদরত হুজুর ‘নাউজুবিল্লাহ’ বলে চিৎকার করে বলতে থাকেন,‘ হারামজাদায় নাস্তিক হইছে! বদমাইশ! তরে যদি আর কুনোদিন মসজিদে ঢুকবার দেখি জুতাপিটা করুম তোরে!’
রাশিদা, সাহিদা ভাইয়ের হয়ে হুজুরের পায়ে পড়ে- ‘ছুটো মানুষ- রাইতে ঠিক মতো ঘুমায় না। কি কইতে কি কইছে! বাপের কব্বরটা নদী ভাংগনে ভাইংগে গেছে এক রাইতে; ওর মাথা আউলাই গেছে!’
‘চুপরাও। তোমাগোর আশকারায় পুলাডা বাড়ছে বেশি। এরে জ্বীনে ধরছে। কাউয়ানাড়ার লতিফ মুন্সিরে না ডাকলে এলাকার পুলাপানগুলারে এই পুলায় উচ্ছনে নেবে!’
আমরা, যুবকেরা হতবিহ্বল হয়ে যাই মোতালিবের তত্ত্ব তালাশে; আমাদের কারুমনে কখনই এইসব প্রশ্ন আসে না; আমরা ছুটি পলাশীহাটা হাই ইশকুলের বিজ্ঞান শিক্ষক শামসুল হক স্যারের কাছে । স্যার পুলাডারে বাঁচান! লতিফ মুন্সি আইলে ওরে ঠ্যাঙ্গাইয়া ছাল তুলে নিবানে!
শামসুল হক স্যার আমাদের পাঁচ গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে ধীরস্থির জ্ঞানী মানুষ। তার হাত দিয়ে বাদিহাটির তাবৎ যুবককুলের ইশকুল পাশ; শামমুল হক স্যার নিরালায় বসেন আবদুল মোতালিবকে নিয়ে-
‘এতো কথা তোমার মাথায় কেমনে আসলো! কার কাছ থিকা শুনলা পরথম?’
‘নিজের মনেই আইলো। বাপে মরলো। তার আগে দাদী, এলাকার কত লুক-!’
‘হেরা সবতে বেহশতে আছে। তুমি মরলেও বেহশতে থাকবা। ব্যাস। হয়ে গেল…এখন হুদাই চিন্তা বাদ দিয়া পড়াশুনা করো একটু। প্রাথমিক পাঠটাও নাই তুমার। পড়াশুনা না করে চিন্তা করতে গেলেই বিপদ…!
‘ বেশি পড়লে বুঝি মরতাম না। আপনের জেডাও এমএ পাশ দিছিলেন। হে-ওতো মরছে!’
‘ হুনো, সবই বিজ্ঞান। মানুষ না মরলে আরেকজন মানুষের জায়গা হবে কি উপায়ে…! এজন্যই মানুষ মরে। জায়গা ছাইড়া দিতে হয়। এইগুলাসব আল্লাহর বিধান!’
‘ খারাপ মানুষরা বেশিদিন বাঁচে। বুড়া হইয়াও ধুকফুক কইরা বাঁচে। দুধের শিশু মইরা যায়!’
‘ এইগুলারও কারণ থাকে। সব আমরা জানি না। আল্লার আইন বড় কঠিন। নিশ্চয় এর পেছনেও বিধান আছে।’- শামসুল হক মাস্টার ধীরস্বরে যুক্তি দেন।
‘কত মানুষ দুইডা ভাতের লাগি পথে পথে ঘুরে!… বানাড়ের পাড়ে পইড়ে থাকে। আর কত মাইনষের শান শওকতের অভাব নাই। এইতাও আল্লাহর বিধান। মোমেনসিং রেলইস্টিশনে গেলাম একবার আব্বার লগে। মাঘ মাস। ঢাকা যামো। দেখি, শীতের মইদ্যে এইটুক গ্যাদা পুলাপান কাপে আর কাপে!…ইতা কেমনে হয়। এইগুলাও আল্লার বিধান!’- ঠ্যাটার মতো কথা বলতেই থাকে আবদুল মোতালিব।
গম্ভীর মুখে শামসু মাস্টার বলেন, ‘ এইগুলা দেখার জন্যই আল্লাহপাক আমার আর তোমার মধ্যে বিবেক দিছে। আমরাই এই বিভেদ বানায়া রাখছি! আমাদের প্রত্যেককে লেখাপড়া করে বিবেককে আরও জাগাইতে হবে। সেইটা আমরা করি না। তুমিতো প্রাথমিক পাশটাই করলা না-’
চিন্তিত মুখে মোতালিব বলে, ‘ প্রাথমিক পাশ করলেও আমি মরতাম! …তাইলে মরবার পর কি হয়! আমি যখন মরুম,আমার কি হবে!’
শামসুল হক মাস্টারও যখন নিশ্চুপ হয়ে যান; আমরা অস্থির হয়ে উঠি- ‘ ব্যক্কল নিহি পুলাডা! এরে এইবার একটা বিয়া দিওন লাগে!’
আয় নাই, রোজগার নাই; বোনদের ঘাড়ে বসে খায়, কে দেবে তাকে বিয়ে? মোতালিব বিয়ে প্রসঙ্গেও অবিচল যুক্তি দেয় আমাদের- ‘ আমারে বিয়া দিয়া তুমরা এরপর আরেকটা শিশু আনার ব্যবস্থা করবা? আমি মরলে ওই বাচ্চার আর বাচ্চার মায়ের হইবো কি!’
নাহ, আবদুল মোতালিব সম্ভবত পাগলই হয়ে যায়; যদিও বাদিহাটি কি কাওয়ানাড়া বা রাধাকানাই গ্রামে বেশ কয়েকজন পাগল ইতিমধ্যেই আছে; কিন্তু আবদুল মোতালিবের মতো এ’ধারার পাগল আর আমরা দেখি না। আবদুল মোতালিব যতো খুশি তার প্রশ্ন আর চিন্তা নিয়ে থাকতে চায় থাকুক, কিন্তু মুশকিল হয়- প্রতিবেশী এক জোয়ান পোলা ঘুমের মধ্যে ‘মইরা যামু’, ‘মইরা যামু’ বলে অজ্ঞান হতে বসলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে সমস্যা দেখা দেয়; আজকাল আবদুল মোতালিব কেবল অজ্ঞান হয়েই পড়ে থাকে না; মুখ থেকে ফেনা ভাংগতে ভাংগতে তার শরীর অসাড় হতে শুরু করে। তখন প্রতিবেশিদের সাথে নিয়ে তার বড় দুইবোন সারারাত তার পায়ে, হাতে সরিষার তেল মাখে। মাথায় পানি ঢালে। দু’চারবার হোমিওপ্যাথি ডাক্তারও দেখানো হয়, চিকিৎসক কোন নিদান দিতে পারে না। বলে, এইটা বড় কোন অসুখ না। ঘুমাইলে ঠিক হয়া যাবে! তারা আবদুল মোতালিবকে ঘুমের ওষুধ দেয়। দু’চারদিন ঘুমিয়ে ঠিক থাকবার পর, আবার এক রাতে তাড়স্বরে চিৎকার জুড়ে আবদুল মোতালিব,
‘মইরা যামু! মইরা যামু…! মরবার পর কি হয়?’
তাই লতিফ মুন্সি ছাড়া আর উপায় থাকে না। এক শুক্রবার বিকালে নাজিম সরকার তার বড় উঠোনে সমবেত প্রতিবেশিদের সামনে জ্বীন ছুটানোর ওস্তাদ, কাওয়ানাড়া গ্রামের লতিফ মুন্সিকে নিয়ে উপস্থিত হয়। লতিফ মুন্সির হাতে বেদম লাঠিপেটায় অর্ধমৃত আবদুল মোতালিব কোনক্রমে বলতে পারে যে- না; সে আর মৃত্যুচিন্তা করবে না। শরিয়ত নিয়ে কোন প্রশ্নই সে অতঃপর করবে না কাউকে। জ্বীন তারে এতোদিন এইসব বলাইছে! মারের চোটে নিস্তেজ আবদুল মোতালিব ক্ষীণ স্বরে বলে- ‘…জ্বীন চইলা গেছে বানাড় নদী পাড় হয়া!’
লতিফ মুন্সির হাতে জ্বীন চিকিৎসার পর আবদুল মোতালিবের পরিবারের আশ্রয়দাতা নাজিম সরকার এক সকালে আন্তরিকভংগিতে বলে, ‘ দুষ আসলে আমাগোরই…। কুনো কাজে নাই, বইনদের ঘাড়ে বইসা খাইলে কুচিন্তা মাথাত আইবোই। … আইজ থিকা গঞ্জে আমার আড়তে বইবে মোতালিব। ডেইলি ২০০ টেকা পাবু। এহন থিকা আমারে তোদের ঘরভাড়া দিতে হইবো। ফিরি ফিরি থাকার দিন শেষ!’
আবদুল মোতালিব মাথা নিচু করে পলাশীহাটা বাজারে নাজিম সরকারের আড়তে বসে। কয়েকদিনের মধ্যে সে ভালোই কাজকর্ম শিখে নেয়; এমনকি মাঝে মাঝে ফুলবাড়িয়া থেকে ভ্যানগাড়িতে করে তাকে নানান জিনিষপত্রসহ আড়তের দিকে যেতে দেখা যায়। আমরা ভাবি, কাজে মন দিয়ে আবদুল মোতালিবের অচেনা রোগ সেরে যায়।
কিন্তু এক জুম্মাবার, পলাশীহাটা মসজিদে নামাজ শেষে সবাই বের হচ্ছে- আবদুল মোতালিব ‘ মইরা যামু, মইরা যামু.’..বলে চিৎকার করতেকরতে আধো অজ্ঞান হয়ে মসজিদের সামনের এক চিলতে ঘাসে উবু হয়ে পড়ে। কেউ তার নাকে স্যান্ডেল ধরে, কেউ মাথায় পানি ঢালে; কোন কাজ হয় না- আবদুল মোতালিবের মুখ দিয়ে ফেনা ভাংগতে থাকে; তাকে আমাদের কয়েকজন যুবক পাজাকোলা করে কেশোরগঞ্জ উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানকার ডাক্তার তাকে স্যালাইন দিয়ে কি’সব নিরীক্ষা করে বলে, ঠিকমতো ঘুম না হওয়ায় ডিলেরিয়াম হয়েছে। আরও আগে তাদের কাছে আনার দরকার ছিল! এতোদিন করছেন কি?
‘ ডাক্তার কয়েকবার দেখছে। …হোমিওপ্যাথি খাওয়ানো হইছে।’ আমাদের একজন বলে।
ডিলেরিয়াম জিনিষটা কি, আমরা জানি না; তবে আমরা বুঝি-আবদুল মোতালিবকে এখন থেকে রাতে ঘুমানোর আগে ১০ মিলিগ্রাম করে ফ্রিজিয়াম ওষুধ খাওয়াতে হবে। তাইলে আর তার এই অসুখ থাকবে না; সে ঘুমাতে পারবে।
ওষুধ খেয়ে কয়েকদিন আবার স্বাভাবিক থাকে আবদুল মোতালিব; তবে দিন পনের পর আবার একদিন বাজারের আড়তে একই কান্ড করে বসে। তবে এইবারের কান্ড খানিক অন্যরকম। সে সোজা নাজিম সরকারকে প্রশ্ন করে বসে- ‘ সারাদিন কাম করি। আমারে দেন ২০০ টেকা। এইবার আপনের ডেইলি ইনকামটা আমারে কন! স্টক কইরা মাইনষেরে বিপদে ফেলাইয়া বাজারে দাম তুইলা জিনিস ছাড়েন। এইবার কন…আপনের ডেইলি ইনকাম কত!’
মুখের উপর আবদুল মোতালিবের এই কথা শুনে নাজিম সরকারের আক্কেলগুরুম হয়ে যায়। আবদুল মোতালিব বলতেই থাকে, ‘ যে সিস্টেম এইহানে, চাইলেই চুরি করতে পারি। কিন্তু চুরি ক্যান করুম! আপনে গোপনে স্টক করবাইন আমরারে দিয়া; লাভের সব টেকা আপনে নিবেন। আপনের ইনকাম আমার জানা দরকার!’
নাটক-সিনেমায় এই ধরনের কথা হলেও হতে পারে; বাস্তব জীবনে- তারপরও যার পরিবারকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছে নাজিম সরকার, পাগল হতে যাওয়া থেকে রক্ষা করে আবদুল মোতালিবকে নিজের আড়তে য়ে এই আক্রার বাজারে মাসে ছয় হাজার টাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে; আর তার মুখের উপর, সাথে তিন/চারজন সাঙ্গ নিয়ে এই কি কথা বলে মোতালিব? নাজিম সরকার তোতলাতে তোতলাতে বলে, ‘ আমার…আমার ব্যবসা। আমার সবকিছু! …তোরে …তোরে আমার জানাইতে হবে আমার ইনকাম! হারামজাদা! ’
তবে বুদ্ধিমান নাজিম সরকার আর বাড়ে না সেদিন; নেহায়েৎ পাগল ছেলে বলে আবদুল মোতালিবের মাথায় হাত বুলিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়; রাতে নিজের বৈঠকখানায় আবদুল মোতালিবকে ডাকে নাজিম সরকার। সরকার সাহেবের ম্যানেজার আমাদের এলাকার যুবক ইদ্রিছের দুলাভাই, করমউদ্দিন; তার কাছ থেকে শোনা কথা; আবদুল মোতালিবকে ডেকে নাজিম সরকার বলে-
‘সবার সামনে আমার মুখে চুনকালি দিতে দিলি! তোরে গুষ্টিসুদ্ধা খাওয়ায়া পাইলাপুইসা এই পাইলাম!’
‘ আপনেও তো কম খান নাই! কি খাওয়া বাকি রাখছেন আমরার?’ চোখে আগুণ জ্বালিয়ে জিজ্ঞেস করে আবদুল মোতালিব।
‘ মানে ? মানে কি কইতে চাস তুই?’
‘ আমার মায়েরে আর বোনদের জিগান গিয়া। কি বাদ রাখছেন আপনে!’ আবদুল মোতালিব ঠান্ডা
স্বরে বলে।
তারপর, দিন কয়েকের মধ্যে এক মধ্যরাতে আবদুল মোতালিবের মরদেহ পাওয়া যায় বানাড় নদীর তীরে। সেই রাতে তার মৃত্যচিন্তা তাকে বাড়ি থেকে অতোদুর কি করে নিয়ে গেল এবং কিভাবেই সে মরে গেল; তা আমরা জানি না। তার মরবার পর কি হলো; তাও আমরা জানি না।