মোহিত কামাল
লোকটার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে ও। মিতভাষী লোকটার অন্তঃসঞ্চারি কথার ঔদ্ধত্যে বাকচাতুর্য নেই। তবে তার উচ্চারিত শব্দের বুক থেকে মায়া আর লাবণ্য ঝরে ঝরে পড়ছে। তাতেই মুগ্ধ, তাতেই বিমূঢ় সামনে বসা রুমানা মিতু।
‘কিছু বলতে চাও, মিতু ?’
‘চাই।’
‘বলো, সংকোচ করছো কেন, বলে ফেল ?’
সংকোচ উড়ে গেল না। দ্বিধার টানে কুঁকড়ে যেতে লাগল তার শরীর। মাথায় চুন লাগলে যেমন কোকড়ায় জোঁক, তেমন করে না হলেও খানিকটা তেমনই। শরীর আরও কুঁজো করে মাথা নিচু করে বসে রইল ও।
‘মনে হচ্ছে কোনো অপরাধী বসে আছে পুলিশের সামনে। নিজেকেই নির্মম এক পুলিশ মনে হচ্ছে। আর তোমাকে আসামি !’
‘চোখ তুলে তাকাল মিতু।’
‘অপরাধ করিনি। অসহায় অবস্থায় আছি। হাত-পাতার ব্যাপার ঘটেছে। মেসের তিন মাসের ভাড়া বাদ পড়েছে। এ মাসে ভাড়ার টাকা দিতে না পারলে বাসা ছাড়ার নোটিশ দিবেন মেস মালিক। বাসা ছাড়লে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে আমার।’
‘ওঃ ! টাকা লাগবে। লোন নিতে এসেছ ? টাকা ধার চাচ্ছ !’
‘ধার পরিশোধ করতে হয়। লোন ও ধার তো একই। আমার সে-ক্ষমতা নেই এখন। আকস্মিক বাবা মারা গেছেন। তিন মাস হলো। তারপর থেকে বিপদে পড়েছি। আপনার কথাবার্তার ভেতর থেকে বাবার আদরের মতো আদর টের পেয়েছি। মনে মনে ঠিক করে এসেছি, আজ সমস্যার কথাটা খুলে বলব আপনাকে।’
মনোযোগ দিয়ে তিনি শুনলেন মিতুর কথা। চুপ করে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে।
সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। ঘরটাকে নিঃশব্দপুরী মনে হচ্ছে। কখনও কাউকে এভাবে নিজের ব্যক্তিগত সমস্যার কথা বলতে হয়নি মিতুর, হাত পাততে হয়নি আগে। অপমান আর লজ্জা বুকে নিয়ে মিতু তাকিয়ে রইল নিচের দিকে। নৈঃশব্দের চাবুক তাকে পেটাচ্ছে এখন। শব্দের ধারের চেয়ে নিঃশব্দতার ধারের আঘাত কম যাতনাময় নয়, জ্বলুনি ছড়িয়ে দিচ্ছে দেহে। মুখের ত্বক ফুঁড়ে বেরোচ্ছে বাষ্প।
‘পরিশোধ করার অঙ্গীকার ছাড়া আমি কাউকে টাকা-পয়সা ধার দিই না। আর তুমি ধার হিসেবেও চাচ্ছ না। নিঃশর্তভাবে পেতে চাও টাকাটা !’
‘শর্ত আছে, আপনার ? কী রকম শর্ত ! পূরণযোগ্য হলে অবশ্যই শর্তটা মেনে নেব। তবে এখন যে আমার টাকাটা চাই-ই। তিন মাসের, আঠার হাজার টাকার চাপে আমি দিশেহারা। পড়াশোনা বন্ধ করে গ্রামের বাড়িতে যেতে চাই না। সর্বোচ্চ ডিগ্রিটা নিতে চাই।’
আবারও চুপ করে থাকলেন তিনি।
সময় যেতে থাকে। নিঃশব্দতা বাড়তে থাকে। নৈঃশব্দের কি বহুতল থাকে? কোন্ তলে অবস্থান করছে ও ! নিজের তল খুঁজে পাচ্ছে না নিজে। ওর মনে হতে লাগল কথার চেয়ে নীরবতার চাপ আরও বেশি ভয়াবহ, আরও বেশি ধ্বংসযোগ্য। নিজের ভেতরটা ভাঙতে লাগল। সিঁড়ির ধাপগুলো খসে পড়ে যেতে লাগল। পড়াশোনা চালিয়ে উপরে ওঠার সিঁড়িটার আকস্মিক পতনের আশংকায় বিভ্রান্ত হতে লাগল ও। সম্ভাবনার উঁচু ভবনটাও ভেঙে যেতে লাগল।
‘আঠার হাজার তো অনেক টাকা, মিতু। এত টাকা কি শর্তছাড়া, পরিশোধের অঙ্গীকার ছাড়া কাউকে দেওয়া যায় ? কেন দেব, বলো ? আমার চেয়ারে তুমি থাকলে এমন প্রপোজাল শুনে কী বলতে, শুনি।’
কথার ধাঁচ আর উদ্যত ভঙ্গিতে কোনো চড়াও হবার আলামত নেই। শব্দের ভেতর থেকে চাতুর্যও ঠিকরে বেরোচ্ছে না। বাস্তবতার স্পর্শ, স্পর্শহীন ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে। এ ছোঁয়াতে রূঢ়তা নেই, কোমলতার পালক স্পর্শে নড়ে উঠে মিতু বলল, ‘আমি আপনার জায়গায় থাকলে ফিরিয়ে দিতাম হাত-পাতা মিতুকে। সৎ উপায়ে অর্জিত টাকা, কষ্টের টাকা বিনা শর্তে, ফিরে পাবার অঙ্গীকারনামা ছাড়া কাউকে দিতাম না, আমার মতো অসহায় কাউকে কাছেও ঘেঁষতে দিতাম না।’
‘তোমার কথা শুনে খুশি হলাম, মিতু। মায়ার কারণে তোমার চাওয়া পূরণ করা যায়, তোমাকে দেওয়া যায়। মায়ার কোনো বিনিময় হয় না। তোমাকে দেখে অন্তরে মায়া জাগে। পিতৃহীন বিপদগ্রস্ত তোমাকে সাহায্য করারও ইচ্ছা জাগে। তবুও আমরা আমাদের চিনতে পারি না। উপকার করে, উপকারের বিনিময় চাইতে অভ্যস্ত আমরা, মানুষরা, সবাই। আর যে উপকার করে তার অপকার করে আমরা উপকারের বদলা দিই। এ গোপন হিংস্রতাও সব মানুষের ভেতর লুকিয়ে থাকে। এ শুয়োর-ইচ্ছা অনেক সময়ই আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। উপকারীর অপকার করতে বাধে না আমাদের, আড়ালের আমরা প্রায় অপকার করে যাই, জানো তুমি ?’
‘না। জানি না। তবে এটুকুন জানি আপনার কোনো অপকার করব না আমি। কোনো দিনও না।’
‘শিওর ! কোনো দিনও না ?’
‘শিওর।’
‘বাহ ! তুমি তো অঙ্গীকার করে ফেললে। শর্তের প্রথম ধাপে সাইন করে ফেললে। এ সাইনটা নকল, বলবে না তো কখনও ?’
কথাটার অর্থ না-বুঝেও মিতু বলল, ‘না। কখনও আমার কথা ফিরিয়ে নেব না। এটাই যদি শর্ত হয়, শর্তটা মানতে আমার অসুবিধে নাই।’
চেয়ারটা সরিয়ে, দেহটা ঝাঁকিয়ে স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে তিনি বললেন, ‘শর্ত গ্যারান্টেড। টাকাটা পাবে তুমি। কিন্তু এ টাকা দেওয়ার কথা কাউকে বলতে পারবে না। রাজি ?’
‘এটাও কি আরেক শর্ত ?’
‘হ্যাঁ। তা মনে করতে পারো।’
‘রাজি। এমন শর্তও মানলাম।’
‘বাহ্। তাহলে শর্তহীন নয়, শর্ত মেনেই টাকা নেবে তুমি, তাই না ?’
‘জি। তা বুঝতে পারছি এখন।’
‘তাহলে তুমি নিঃশর্তভাবে টাকাটা নিচ্ছ না। সব মেনেই পেতে চাচ্ছ ?’
‘জি। বললাম তো পড়াশোনা শেষ করার জন্য মানা যায়, এ শর্তটা মেনেই টাকাটা পেতে চাই।’
‘টাকা পেয়ে আমার বাসায় আসা বন্ধ করবে না তো ?’
‘এতটা অকৃতজ্ঞ হব কেন, আঙ্কেল ?’
‘গুড। তাহলে আসা বন্ধ করবে না, যোগাযোগ বন্ধ করবে না, কী বলো ?’
‘এটাও কি আরেকটা শর্ত ?’
‘হ্যাঁ। ব্রিলিয়ান্ট ! ঠিকটাই ধরেছে।’
‘এটাও মানলাম। তবে আমার পরীক্ষার সময় ছাড় দিতে হবে।’
‘ওঃ ! শর্তে অগ্রিম ছাড় চাচ্ছ। বাহ্ ! তাহলে মেনে নিচ্ছ সব ! কী বলো ?’
‘জি, আঙ্কেল।’
দুই
একসঙ্গে আঠার হাজার টাকা দেখার সৌভাগ্য এখনও হয়নি। আজই প্রথম দেখল মিতু। টাকার প্যাকেটটা হাতে নেওয়ার পর ভয় জেগে উঠল তার মনে। কী করবে, কী বলবে, কিছু বোঝার আগেই বোধশক্তি শূন্য ডিগ্রিতে নেমে এলো। টাকা নিয়ে বাড়ি ত্যাগ করার সময় মাথা ঘুরিয়ে সে বলল, ‘এতগুলো টাকা গোপনে দিচ্ছেন কেন !’
কোনো জবাব পেল না মিতু।
আবারও প্রশ্ন করল, ‘গোপন দান, মহৎ দান। একারণেই ?’
‘না।’
‘যাও। আগে তোমার সমস্যা মেটাও। সব কিছুর জবাব হয় না। এত পরিশ্রমে অর্জিত অর্থ কেন গোপনে দিচ্ছি, তার জবাব এ মুহূতের্হ দিতে পারছি না। তবে আশা করি উত্তর পেয়ে যাবে।’
ক্যাজুয়াল ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বের হবার সময় মিতু শুনল মুরব্বির কথা, ‘সিএনজি অটোরিকশায় উঠো না। যেভাবে যাওয়া আসা করে অভ্যস্ত সেভাবেই যেও।’
মাথা ঘুরিয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে মিতু জবাব দিল, ‘আচ্ছা।’
সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। চোখের পানি বাঁ হাতে মুছে মিতু আবার বলল, ‘সরি, আঙ্কেল। কেঁদে ফেললাম। বাবার কথা মনে পড়ে গেল। বাবাও আমাকে এভাবে সাবধান করতেন !’
মেয়েটি চলে যাওয়ার পর তিনি ঘরে ঢুকে গেলেন। দরজা বন্ধ করে দিলেন। শূন্য ঘরে কত রকমের শূন্যতা থাকে। সব ধরনের শূন্যতার যোগফল থেকে জেগে ওঠে মেগা শূন্যতা। মেগা শূন্যবৃত্তের কেন্দ্রে হঠাৎ আলোর বিন্দু দেখে তিনি চমকে উঠলেন। কোত্থেকে আসছে এ রোশনি ! চোখ বন্ধ করে কল্পরোশনি উড়িয়ে দিতে চাইলেন। পারলেন না। জানালার পর্দা টেনে দিলেন। রোদে ভরে গেল ঘর। চারপাশটা হঠাৎ প্রসারিত হতে লাগল। এ ঘরে স্ত্রী ছিল। এখন নেই। সবাইকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে জগৎ-সংসার ছেড়ে । বড় ছেলেটা অস্ট্রেলিয়ায় সেটেল্ড হয়ে গেছে। আর মেয়েটা শ্বশুরবাড়িতে গেলেও এখন উপরের ফ্ল্যাটে থাকে। সে নিজেই প্রতিষ্ঠিত, জামাতাও। বাবাকে দেখভাল করার জন্য একই বিল্ডিংয়ে উঠে এসেছে। ঘরে কাজের লোক আছে। নিজে এখনো অচল হয়ে যাননি- বড় রকমের শূন্যতা আর ‘এমটিনেস্ট সিন্ড্রম’-এ ভুগলেও নিজের শারীরিক ও মানসিক ফিটনেস দেখে কেউ ভাবতেই পারবে না তার ভেতরটা ভেঙেচুরে যাবার খবর। বুঝলেন, জসিম উদ্দীনের ‘কবর’ কবিতার মতো ট্র্যাজেডির মালা গেঁথে চলেছেন, জীবনচক্রে ফেসে আছেন। বুঝতে পারলেও, সব যে বোঝেন,তা নয়। তার মাঝেমধ্যে মনে হয় ফ্যানের মতো হুকের মধ্যে ঝুলে আছেন তিনি। সেই নিজের ভেতরই, মিতুর উপস্থিতি, গোপনে টাকা দেওয়ার কারণে, কেমন একটা পরিবর্তন ঘটাতে লাগল। এ পরিবর্তনের ঢেউয়ের উৎস কী ? গভীরতা কত ? তল থেকে নেড়ে উঠছে ভুবন, টের পাচ্ছেন না। কেবল পরিবর্তনটা ধরতে পাচ্ছেন।
‘এত্ত টেহা মাইয়াডারে দেওন ঠিক হইলো, ছাব ?’ দীর্ঘদিন ধরে ঘরে কাজ করতে থাকা বয়স্ক বুয়ার এমন প্রশ্ন শুনে থতমত হয়ে গেলেন তিনি।
‘তুমি দেখে ফেলেছ ?’
‘হ। দেখুম না ক্যা। চোক কি আন্ধা ?’
‘তো, অসুবিধা কী ? মেয়েটা বিপদে পড়েছে। বাবা মারা গেছে। হোস্টেল-মেসের খরচ চালাতে পারছে না। পড়ার প্রতি তার দারুণ আগ্রহ। এমন একটা মেয়ের পড়াশোনা যেন শেষ করতে পারে, বাবাবিহীন পৃথিবীতে যেন বিপদে না পড়ে, এ উদ্দেশ্যে ওকে হেল্প করা যায় না ?’
‘যায়, ছাব। তো গোপনে করলেন ক্যা। গোপনে টেহা দেওন তো ভালা লক্ষণ না।’
‘বলো কি? দান তো গোপনেই করতে হয়। ডান হাত দিয়ে দান করলে বাঁ হাত যেন টের না পায়, এটাই দানের মাহাত্ম !’
‘হেইডা ভালো কথা। তো, আমার মন কইছে, মাইয়াডারে আফনে ফাঁদে ফেলতে চান ! কচি মাইয়াডা কিচ্ছু বোঝে না। সরল মনে টেহা চাইছে। আর আফনে সরল মনে দেন নাইক্যা। গোপনে কাম হাসিল করোনের ফন্দি আছে আফনার।’
স্তব্ধ হয়ে গেলেন তিনি। নিজের ভেতর কি আরেকটা কেউ লুকিয়ে আছে! সে লুকোনো লোকটার মধ্যে কি কু-মতলব আছে ? ভাবলেন তিনি। উত্তরের তলটা ধরতে পারলেন না। শেকড় আছে। শেকড়ের বিস্তারের গতিপথও খুঁজে পেলেন না। কোন অতল থেকে তলের দিকে চলেছেন, বুঝে উঠতে পারলেন না। তবে বুয়ার সঙ্গে আর কথা বাড়ানোরও ইচ্ছা খুঁজে পেলেন না। মুখ ঘুরিয়ে নিজের খাটে গিয়ে উঠলেন। শোয়ার চেষ্টা করলেন। শুয়েছেনও। অসময়ে ঘুম আসছে না চোখে। তবু চোখের পাতা ভারি ভারি লাগছে। নিজের ফেলে আসা দিনগুলোতে জাল ফেলতে চাইলেন। গোপনে অসৎ কোনো কাজ করছেন কিনা তন্ন-তন্ন করে খুঁজতে লাগলেন। অনেক ঘটনা মনে পড়ছে। হ্যাঁ। অনেক কাজ গোপনে করেছেন। গোপন কাজে তো কোনো অপরাধ ছিল না, তখন বুঝতে পারেননি। মনে হয়েছিল যা করেছি গোপন থাকবে, কেউ জানবে না, দেখবে না, সে-কাজে তো অপরাধ হচ্ছে মনে করতে পারেননি তখন। কাউকে ফাঁদে ফেলেননি। যা কিছু করেছেন, পেয়েছেন নিজের
স্বচ্ছলতার মধ্যে। এখন এ একাকিত্ব আর শূন্যতার মধ্যে, দেহের জরা-খরা আর মনের গোপন দহনের ভেতরও কি লোভ-লালসা, কুৎসা, ঈর্ষা, বিষফল আর শয়তানি ঢুকে বসে আছে ? পঞ্চাশোর্ধ্ব বুয়া কি অভিজ্ঞতার চোখ দিয়ে তা দেখে ফেলেছে ? এ জন্য মনিবকে এত কঠিন কথা বলে ফেলেছে ! ও মনিবের ভালো চায় ! কোনো ভরাডুবির আগেই ভালো চাইতে গিয়ে বলে ফেলতে পেরেছে ! ব্লাকমেইলিং করছে না তো বুয়া! দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বেরোতে থাকা কঠিন সব ভাবনা বেদনা জাগাচ্ছে কেন? নিজে কি সত্যিই অপরাধী ! শঠ ! নোংরা মানুষ ! নিজের মনের আলো ঢেকে যাচ্ছে মৃত উপগ্রহের আঁধারে। ভাবনার গ্রহ-উপগ্রহরা ক্রমশ আলো হারিয়ে মরে যাচ্ছে। মরা আলোয় আর কি কখনো নতুন ফুল ফুটবে জীবনের !
‘আপনার কন্যা ফোন দিচ্ছে। উপরে যাওন লাগব। যাবেন? নাকি হে নিচে আইব ?’
নির্জীব অবস্থার চাপা-পর্দা উড়ে গেল। নড়ে উঠল শরীর। মোচড় দিয়ে দেহটাকে টেনে বসালেন। তার মনে হলো দেহের ভেতরে কলকব্জায় জট লেগে গেছে। কোনো অঙ্গই জোড়া লাগছে না। শক্ত করে বসতে পারছেন না। আবার দেহটা এলিয়ে দিলেন বিছানায়। মাথাটা বলিশে রেখে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘ওকে ডাকো।’
বুয়া চলে যাওয়ার পর ভাবলেন নিশ্চয় মেয়ে প্রয়োজনে কল করেছে। প্রয়োজন ছাড়া উপরে ডাক আসে না। মুখ ফিরিয়ে শুয়ে থাকলেন তিনি।
কিছুক্ষণ পরই মেয়ে মিনু এসে বলল, ‘সে কি আব্বা ! অবেলায় শুয়ে আছেন ! শরীর খারাপ
করেছে ?’
ওপাশ থেকে এপাশে ফিরলেন তিনি। উঠে বসতে বসতে বললেন, ‘কী প্রয়োজনে ডেকেছ, বলো।’ মেয়ের প্রশ্ন এড়িয়ে নিজের প্রশ্ন করলেন তিনি।
‘নাহিয়ানের স্কুলে বার্ষিক ফি ত্রিশ হাজার টাকা লাগবে। মনে ছিল না, ওর বাবার কাছে চেয়ে রাখিনি। জরুরি লাগবে। আজ লাস্ট ডেট। টাকা খুঁজতে গিয়ে দেখি মাত্র দশ হাজার ক্যাশ আছে।’
‘ওঃ ! টাকা লাগবে ! ব্যাংক থেকে বাকি টাকাটা তুলে নাও।’
‘আমি তো ব্যাংকে লেনদেন করি না। মতিঝিলে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। নাহিয়ানের বাবা এসব কাজ করে। আর সে গেছে ফিল্ডে। আসতে দেরি হবে। আপনার কাছে তো আছে। গতকালই তো বাড়ি ভাড়ার পঁচিশ হাজার ক্যাশ পেয়েছেন।’
‘কে বলল তোমাকে ?’
‘ভাড়াটিয়াই বলেছে।’
‘ভাড়াটিয়ার সঙ্গে টাকা-পয়সা নিয়ে আলোচনা করো নাকি ?’
‘না তো ! আলোচনা করব কেন? কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন।’
মেয়ের এ কথা বিশ্বাস হলো না। তিনি সতর্ক আর অনুসন্ধিৎসু চোখে তাকালেন কন্যার মুখের দিকে। সেখানে খেলা করছে অবিশ্বাস আর সন্দেহের ছাপ।
‘আমার কাছে মাত্র সাত হাজার আছে। টাকাটা এখন হাত ছাড়া করতে চাই না।’
‘আপনি তো ঘর থেকেই বেরোননি। তবে টাকা গেল কোথায়, আব্বা ?’
জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলেন তিনি। মিতুকে বলেছিলেন টাকা দেওয়ার ব্যাপারটা গোপন রাখতে। ওটা ছিল দান। দান করে প্রচার করতে নেই, দান পেয়েও প্রকাশ করতে নেই। তাই সতর্ক করেছিলেন মিতুকে। মিতু কি এ কথা বলে দিয়েছে? নিজের মেয়ে কি তা জেনে ফেলেছে ? নাকি বুয়াই প্যাঁচ লাগিয়েছে? বছরের মাঝামাঝি সময়ে কেন বার্ষিক ফি লাগবে নাহিয়ানের? মিথ্যা ঘটনা দিয়ে কি সে সত্য চাপা দিতে চায় ও ? সন্দেহজনক কিছু খুঁড়ে খুঁড়ে বের করতে চায় ?
‘অল্প বয়সী একটা মেয়ে আসে আপনার কাছে। ওকে কি টাকা-পয়সা দিয়ে দেন? ওকে বিয়ে করতে চান আপনি ?’
হতবাক হয়ে গেলেন তিনি। নির্বাক তাকিয়ে রইলেন আপন আত্মজার দিকে।
‘আব্বা, বুড়ো বয়সে সবার ভিমরতি হয়। আপনার হবে তা ভাবতে পারিনি !’
নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে মেয়ে। হিমশীতল কষ্টের স্রোত ছুটে মস্তিষ্ক থেকে নামতে লাগল শিরদাঁড়া বেয়ে নিচের দিকে। মেয়ের কথায় জবাব না দিয়ে একবার তাকালেন এ ঘরের বাইরের দরজার দিকে। ‘বুয়াটাই কি সত্যিই কুটচাল করল ! আত্মজার মনে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছে সেই-ই !’
‘ঐশ্বর্যের চেয়ে দামি সম্পদ বুদ্ধিমত্তা। আর সবচেয়ে বড় দারিদ্র্য হচ্ছে মূর্খতা।’ মুহূর্তে দর্শনটা মনে পড়তে লাগল ওনার। মনে হচ্ছে মেয়ে বুদ্ধিমত্তা হারিয়েছে, কান কথা শুনে মূর্খতার সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেছে দারিদ্র্যের চূড়ায়। ওই দারিদ্র্য অর্থের চেয়ে বেশি মনের। অর্থের দারিদ্র্য দূর করা যায়। মনের দারিদ্র্য মোছে না। ভাবতে ভাবতে চুপ হয়ে গেলেন তিনি।
মিনু বেরিয়ে যাচ্ছে। উদ্যত তার মুখভঙ্গি, জিদ আর ক্ষোভের সঙ্গেও মিশে আছে ঔদ্ধত্যপূর্ণ দারিদ্র্য। দরজা পেরিয়ে যাবার পর বুয়ার উদ্দেশ্যে বলল, ‘ওই শয়তান মেয়েটা বাসায় আবার এলে আমাকে খবর দিও। ওর পা ভেঙে দেব। এ বাড়িমুখো যাতে না হতে পারে, ব্যবস্থা করে দেব।’
তিন
‘এত টাকা একসঙ্গে কোথায় পেলে, রুমানা?’
‘এক সজ্জন ব্যক্তি দিয়ে দিলেন ?’
‘এমনি এমনি কেউ এত টাকা দেয়, গাধা ?’
‘তা দেয় না। উনি দিয়েছেন। খুব অমায়িক আর ভদ্র লোক তিনি।’
দুই রুমমেটের দুটো প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মনে পড়ে গেল ওনার কথা। টাকা দেওয়ার বিষয়টা গোপন করতে হবে। গোপন করা গেল না, প্রশ্নের উত্তর না দিলে ওরা ছাড় দেবে না ভেবে, শর্তের কথা মনে না থাকায় বেফাঁস উত্তর দিয়ে বুঝল, ভুল হয়ে গেছে। পরক্ষণেই বুঝল লাগামছাড়া ভুল করা যাবে না।’
‘কোথায় থাকেন তিনি? কী করেন. কীভাবে পরিচয় ঘটল তোমার এমন পাত্তিওয়ালার সঙ্গে ?’
উত্তর দিলে শর্ত ভঙ্গ হবে। শর্ত ভঙ্গ করতে চায় না রুমানা মিতু। তবে ওদের প্রশ্নের চাপ মোকাবিলার জন্য কৌশলের আশ্রয় নিয়ে বলল, ‘জরুরি বাইরে যেতে হবে।’
‘ওই সজ্জন লোকটার কাছে যাবে? যার কাছে বিছানায় শুয়ে টাকা জোগাড় করেছ ?’
ঠাস করে ঘুরে দাঁড়াল রুমানা। উদ্যত চোখে তাকাল ওদের দিকে। চোখ থেকে বেরোতে লাগল
ক্ষোভ আর বিস্ময়ের আগুন।
‘একি প্রশ্ন ! একদমে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া ! ছিঃ !’ বলেই বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিল মিতু।
‘দেখো মিতু, এসব চলবে না। আমাদের রুমের বদনাম হবে এমন কাউকে রুমে থাকতে দেব না আমরা। প্রয়োজনে নতুন বর্ডার নেব।’
মাথায় বাড়ি পড়ল। আবার ঘুরে দাঁড়াল রুমানা। এবার চোখের ভেতর থেকে আগুন নয়, ছুটে এল জলকণা। কাঁদতে কাঁদতে আবার বুক ভাঙা চিৎকার করে বলল, ‘এসব কি বলছ তোমরা ?’
‘ঠিকই বলছি। অনেক মেয়ে এখন এসব করছে। টিউশনির নাম করে…। তাই তোমাকে সতর্ক করছি। আর এ ধরনের কাজের প্রমাণ পেলে তোমাকে এ রুমে জায়গা দিতে পারি না আমরা। কোনো পুরুষ এমনি এমনি এতগুলো টাকা দিয়ে দিবে, হতেই পারে না। বিষয়টা খোলাসা করো। নইলে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমাদের।’
ফাঁদে আটকে গেল রুমানা। খুলে বলল সব কথা। উপকারীর নাম ঠিকানা, মোবাইল নম্বরও দিতে বাধ্য হলো। দিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে প্রশ্ন করল, ‘তোমরা কি ওনাকে কল করবে ? দান করছেন কিনা খোঁজ নেবে ?’
‘নিতে হবে। নইলে সে-লোক যতই সজ্জন আর ভদ্র হোক, যত বুড়ো বা জোয়ান হোক, তোমার দেহের দিকে হাত দিবে। আমরা তোমার সঙ্গে আছি, টাকা দেওয়ার কথা জানি, একথা শুনলে আর অশুভ কাজে সাহস পাবে না বুড়া। গুটিয়ে যাবে। যা করব, আমাদের রুমমেটের ভালোর জন্যই করব।’
চার
তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি শর্ত ভঙ্গ করেছ, মিতু ? আমার দানের কথা তোমার রুমমেটদের বলে দিয়েছ ?’
সব খুলে বলে জোর দিয়ে মিতু বলল, ‘বলতে বাধ্য হয়েছি।’
‘শর্ত আর ভাগ্য অনেক সময় নিজের হাতে থাকে না। অন্যের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তখন অন্যের ক্রীড়নক হয়ে যাই আমরা।’
‘জি। ঠিকই বলেছেন। আপনিও শর্ত ভঙ্গ করেছেন। দানের কথা আপনার মেয়েকে বলে দিয়েছেন। তিনি আমার ফোন নম্বর আপনার সেট থেকে কালেক্ট করে শাসিয়েছেন আমাকে, যেন কখনও এ বাড়িতে না আসি।’
‘হতবাক হয়ে রইলেন তিনি। এ খবর জানতেন না। কিছুক্ষণ পর প্রশ্ন করলেন, ‘আর কিছু বলেছে ?’
‘বলেছে। আপনি নাকি আমাকে বিয়ে করবেন। এমন কথা বলতেও বাধেনি আপনার মেয়ের মুখে।’
‘তবুও সাহস করে কেন এলে ?’
‘আমি তো কোনো অপরাধ করিনি। আপনিও না। তবুও এসেছি একটা কথা জানতে। আশা করি জবাব দিবেন। সবার কথা থেকে বুঝেছি, পুরুষ মানুষ যে বয়সিই হোক না কেন, মেয়েদের টাকা ধার বা দান করলে তাদের দেহের প্রতি লোভ থেকে দেয় ! আপনারও কি তেমন কোনো লালসা লুকিয়ে ছিল মনে ? আড়ালে কি আমাকে সত্যিই ফাঁদে ফেলার ইচ্ছা রাখেন ?’
কী বলবেন তিনি ! এমন অভিযোগের কী জবাব হতে পারে। এমন কোনো তাগিদ কি আসলেই লুকিয়েছিল নিজের মগজে, জানেন না। চুপ করে রইলেন।
‘উত্তর না পেলে আপনার অন্য শর্তগুলো ভঙ্গ করতে হবে। আপনার সঙ্গে যোগাযোগ কিংবা এ বাড়িতে আসা বন্ধ হয়ে যাবে।’
তার বুকের কপাট খুলে গেল, অতীত ছুটে এসে দাঁড়াল চোখের সামনে। অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়েছিলেন তিনি। অনেক কষ্টে পড়াশোনা চালিয়েছিলেন। অনেকের সাহায্য পেয়েছিলেন ছোটবেলায়। তাই বড় হয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়ে বহু ছেলেকে পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছেন। মিতুর এক শিক্ষকও জানত সে-কথা। এ কারণে তিনিই মিতুকে পাঠিয়েছিলেন তার কাছে। তার দানের পেছনের খবরটা কেউ জানে না, কাউকে বলেন না, বলেননি, নিজের আনন্দেই দান করেন। সে-দানে কারও পড়াশোনা বন্ধ না হলে, চূড়ান্ত আনন্দ লাভ করেন। এ আনন্দ কি জাগতিক কোনো চাওয়া-পাওয়া, লোভ-লালসা মিটিয়ে পাওয়া যাবে ? যাবে না। মনের মধ্যে জেগে ওঠা সব কথা খুলে বললেন মিতুকে। বলতে ভুললেন না ‘অনেক বিপন্ন, বিপদগ্রস্ত ছেলেকে পড়াশোনার ব্যাপারে সাহায্য করেছি। এ প্রথম একটি মেয়ে, তোমাকে টাকা দিয়েছি। এত বড় অঙ্কের টাকা একসঙ্গে কাউকে দিইনি। দিতে গিয়ে তোমাকে নানা প্রশ্ন করে তোমার প্রয়োজনটা ঠিক কিনা বোঝার চেষ্টা করেছি। আমি দুঃখিত। সান্ত্বনা এই, প্রকৃত বিপদগ্রস্তের পাশে আছি আমি।’
শুনে মিতুর মনে অপরাধ জেগে উঠল, স্বগতোক্তি করে বলল, ‘মানুষ এমন কেন ? সব না জেনে-বুঝে কেন একজন অন্যজনের বুকে শেল বসায়? কেন ঈর্ষা করে? কেন হিংসা করে ?’
এ কথার উত্তর না দিয়ে তিনি বললেন, ‘আমার মায়াময় শর্ত উইথড্র করলাম। তোমাকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে না। আমার বাসায় আসতে হবে না। তাতে আমার মেয়ে শান্তি পাবে। তোমার রুমমেটরাও। তবে সর্বশেষ শর্ত দিচ্ছি : পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে তোমাকে। মানুষ হতে হবে। মানুষ হয়ে একদিন বুক ফুলিয়ে এসে বলবে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছি। তখনই আমি ফেরত পাব দানের প্রতিদান, পূর্ণ হবে আমার সব শর্ত।’
লেখক : মোহিত কামাল
কথাসাহিত্যিক, বাংলা একাডেমি লরিয়েট, ২০১৮।
সম্পাদক, শব্দঘর।
ইমেইল :shabdagharbd@gmail.com, drmohitkamal@yahoo.com
ঠিকানা : বাড়ি- ২৬ (ফ্ল্যাট- ডি২), রোড- ০৬, ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা, ঢাকা- ১২০৫,
Bangladesh. মোবাইল : +৮৮০১৭১১৮৩২৯৫৫