শুকনো-পাতলা উনিশ বছরের তিতলি আজ না হলে কাল ঠিকই ট্রেনের নিচে শুয়ে গেলে তার মৃত্যুর কারণ কেউ জানবে না ভেবে কষ্ট হয়। রক্ত, মাংস, হাড্ডি থেতলে যাওয়া শরীরটা উৎসুক মানুষেরা ধারে-কাছে দূর-দুরান্ত থেকে দেখতে আসলে কেউ ভয়ে কেঁপে উঠবে, কেউ দুঃস্বপ্ন দেখবে, কারো প্লীহা চমকে জ্বর এসে দু’দিন পর মরে যাবে, কেউ ভাত খেতে গিয়ে বমি করবে, কেউ হয়তো ট্রেন লাইনের ধারে-কাছেও যাবে না ম্যালাদিন। কানেকানে ঘটনাটা তিল থেকে তাল হয়ে একসময় চাপা পড়ে যাবে ঘটনাবহুল বহু ঘটনার নিচে। রেলওয়ের কর্মকর্তা তার কাটা মুণ্ডটা পেটের উপর বসিয়ে আঞ্জুমানে মফিদুলে পাঠিয়ে দেবে-ভাবতেই ডাগর কালো চোখ গড়িয়ে জল নিঃশব্দে ঘাস ভিজিয়ে দেয়।
প্রতিদিন না হলেও মাসে দু-একটা প্রাণীর দেহ কেউটের মতো শুয়ে থাকা রেল লাইনের ঘাস, মাটি, পাথর রাঙিয়ে যায় রক্ত-মাংস-গুমুত-নাড়ি ভুঁড়িতে। এই তো কদিন আগে আদম আলী মার্কেটের সব্বুর মিঞার ছোট ছেলে কানে হেড ফোন লাগিয়ে এফএম রেডিও শুনতে শুনতে বুঝতেই পারল না ট্রেন কখন তাকে টুকরো টুকরো করল। ফায়দাবাদের ছাপড়া মসজিদের রিকশাওয়ালা মজিদের বউ স্বামীর সঙ্গে রাগ করে সোজা সাত মাসের শিশুসহ গলা দিল। ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেল কোলের শিশুটা। দেওয়ান বাড়ির শফিক সাহেবের ১০ বছরের ছেলে স্কুল থেকে ফেরার পথে ট্রেনের ধাক্কায় হাত-পা-মাথা আলাদা হলে তিতলি বাদে সবাই দেখতে গেল।
সকাল-বিকেল-দুপুর-রাত ‘কাটা পড়ছে’, ‘কাটা পড়ছে’ এরকম সোরগোলে কান সোয়ে গেলে ঐরকম কিছু একটা মানুষেরা শুনুক অথবা তার সঙ্গে ঘটুক, সেই উদ্দেশ্যে বের হয় কাউকে কিছু না জানিয়ে। শুধু একটা টিরকুট লিখে আবার কুটিকুটি করে ছিড়ে রেখে আসে বালিশের নিচে।
উত্তরা ৮-৬-৪ নং সেক্টর যেখানে শেষ সেখান থেকে শুরু দক্ষিণখান। দুটো শ্রেণীকে বিভক্ত করে মাঝখান থেকে চলে গেছে রেলপথ। ষাটের দশকে ডিআইটি যখন মডেল টাউন বানাবার উদ্দেশ্য নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে জমি অধিগ্রহণ করে ক্ষতিপূরণের নামে প্রহসন করেছিল তখন স্থানীয়রা (কোটবাড়ি, জামতলা, জয়নাল মার্কেট, দেওয়ানবাড়ি, ফায়দাবাদ, কাঁঠালতলা, কসাইবাজার, ছাপড়া মসজিদ, প্রেমবাগান, দক্ষণিখান, সুক্কুরআলী মসজিদ রোড, উত্তরখান, চালাবন ইত্যাদি) কোণঠাসা হয়ে গড়ে তোলে আনসিভিলাইস্ড এক জাতি; অন্তত উত্তরাবাসীর কাছে তাদের সংজ্ঞা এমনই দাঁড়িয়ে গেছে। সিভিলাইস্ড সোভার উত্তরার গৃহকর্মীর অথবা মানুষ কাঁচা বাজার করতে কদাচিৎ রেললাইনের ওপার গেলেও তারা এদিকে না এসে পারে না অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা সেখানে কোনো প্রশস্ত রাস্তা নেই বলে।
নতুন নাম নিয়ে উত্তরা মডেল টাউন প্লান মোতাবেক বাক্সে বাক্সে অভিজাত শ্রেণীতে বন্ধী। রেলের ঐদিকটাতে অপরিকল্পিত ভাবে মাঠ-ঘাট-রাস্তা-পুকুর-নালা-নর্দমা-নদী-খাল দখল করে গড়ে ওঠে বহুতল ভবন, ছোট-বড় টিনের ঘর, বেড়ার ঘর, ছাপড়া ঘর।যার মধ্যে বেশির ভাগ অংশগুলোতে স্থানীয় জমিদার থেকে আরম্ভ করে চোরছেঁচড় কারোর আর বসবাসে বাঁধা থাকে না। সেখানে প্রতিদিন নিত্য নতুন ঘটনা লেগে থাকে যা সবশ্রেণীর মানুষদের ইডিয়েটবক্সে দেখা বস্তাপঁচা কাহিনীর চাইতে বেশি উপভোগ্য। কৌতূহলী দৃষ্টি জানালা-দরজা ও বেড়ার ফাঁক-ফোকর দিয়ে উঁকি-ঝুঁকি দিতে ভুল করে না। আশ্চর্য, সেখানে তিতলির ব্যাপারটি নিয়ে কেউ কোনো কৌতূহল দেখাল না! কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই।
সন্ধ্যার আলোছায়ায় ঘরমুখি পাখিরা ফিরতে থাকলে উত্তরার কিনার দিয়ে যমজ ভাইয়ের মতো শুয়ে থাকা ট্রেন লাইন ধরে অলস আর নিস্পৃহ ভঙ্গিতে হাঁটলে তিতলিকে কেউ জিজ্ঞেস করে না, ’এই ভর সইন্ধাবেলায় তাহেরের মাইয়া কই যাও!’
অন্ধকার নেমে এলে সেদিন কেন জানি সবাই উৎসুক হয়ে চ্যানেলে চ্যানেলে দেখল মিশরের কিশোর ফারাও তুতেনখামেনের মৃত্যু রহস্যের সমাধান। বেশ কিছুদিন ধরে মানুষের উৎসাহের কমতি ছিল না। বিজ্ঞানীরা বছরের পর বছর ধরে ১৯ বছর বয়সী এই রাজার মৃতদেহের মমির ডিএনএ ও রক্তকোষ পরীক্ষা করে ম্যালেরিয়ার জীবাণু খুঁজে পান। তিন হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে আবিষ্কৃত ফারাও অষ্টাদশ রাজবংশের বংশধর তুতেনখামেনের মৃত্যু কী রথ থেকে পড়ে হয়েছিল নাকি পারিবারিক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল ব্যাপাটি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তিতলি ভাবে অন্য কথা; সে তখনকার সময়ে মিশরিয়দের বিকৃত আকৃতি নিয়ে জন্ম নেওয়ার কারণ সম্পর্কে শুনেছিল কুমুআপুর কাছে। মূলত ভাই-বোন বিবাহ প্রথা চালু থাকায় জেনেটিক প্রবলেমের কারণে তাদের মাথার গড়ন হতো লম্বাটে যেটা ঢাকবার জন্য ব্যাবহার করত বাহারি সব টুপি বা মুকুট। আর বাকিরা অন্ধ নেফারতিতির মতো ভাগ্যকে মেনে নিয়ে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করত। আহা! কত কঠিন পরিণতি মাইনা নিত নিয়তির অমোঘ শিশুরা!’ তিতলি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ভাবে, অখনও দুইন্নাত হেরম সম্পর্কের কারণে বাচ্চা জন্মায় তাইলে সমাজ কীভাবে লইব! সমাজের কথা বাদই দিলাম, হেরও কি তুতেনখামেনের লাহান কঠিন রোগ হইব। হেরও অকাল মৃত্যু হইব! হেও কি হইব ক্ষণজন্মা! তিতলির শিরদাঁড়া বেয়ে একটা কষ্ট ওপর দিকে উঠে আসে। মনে পুনরায় প্রশ্নের উদয়, তয় মসজিদের হুজুর কইছিল, আদম-হাওয়ার সন্তানরাও তো ভাই-বোন আছিল। হাবিল-কাবিলের কারণে আইজ আমরা দুইন্নাত টিকা আছি। তাইলে আমরাও কী কঠিন কোনো রোগে ভুগতাছি! আহ্ খোদা! দুইন্নাত না জন্মাইলে কী এমন ক্ষতি হইত! এখন তুমিই কও আমি কী করবাম!’
এই অনাকাক্ষিত সত্যের সমাধান কী! তিতলি জানে না। মনের ভেতর গজিয়ে ওঠা নানান প্রশ্ন-আক্ষেপ-অনুযোগ-অভিযোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য একবার ভেবেছিল ফায়দাবাদ চৌরাস্তায় মুদি দোকানে বসা বাবাকে সব খুলে বলবে। বাবা তাকে ট্রেনের নিচে ঠেলে দিলেও পরকালে পিতৃত্বের দাবি ছেড়ে দিত না। তবুও এই অসম্ভবের দুনিয়ায় এই মুহূর্তে বাবাকেও কতটুকু বিশ্বাস করা যায়! কুমুআপুর কাছে শুনছে, সভ্য দ্যাশে বলে বাপের হাতে বাচ্চার ডাইপার চেঞ্জ করতে যাইয়া বহু শিশু ধর্ষিত হয়। আবার হেই দ্যাশে বাপ এবং মাইয়ার ঔরসের সন্তানের স্বীকৃতি লাইগা স্লোগান তোলে।’ আসলে মানুষের মধ্যে একটা আদিম সমাজের লক্ষণ আছে, যেটা ঘুরে ফিরে মানুষের দ্বারস্থ হলে সে টোটেমভুক্ত মানুষের মতো টোটা হাতে বেরিয়ে পড়তে চায়; অন্তত তিতলির বাবা-ভাইয়ের মধ্যে সে প্রবণতা ছিল। সেই রাতে তার নিজের ভাই বটি গলায় ধরলে তিতলি নির্বাক হয়ে গিয়েছিল।
তিতলিকে এতোসব জ্ঞান দিক্ষা দিয়েছিল কুমুআপু। বর্তমানে সে এনজিওর প্রজেক্ট ‘ডাউরি’ কাজ নিয়ে ভোলার প্রতিটি থানার প্রত্যন্ত অঞ্চল তজিমউদ্দিন, বোরহানউদ্দিন, চরফ্যাশন, সিডর চর, মনপুরার বাড়ি বাড়ি হেঁটে যৌতুক দেওয়া-নেওয়ার ডাটা কালেকশন করছে। অথচ কুমুআপু জানত তিতলির বিয়ে হচ্ছিল না যে কয়টা কারণে তার মধ্যে যৌতুকও একটি। সব জেনেও কুমুআপু কোনো পদক্ষেপ নিত না দেখে মাঝে-মধ্যে তিতলির রাগ সপ্তমে চড়ে গেলে সে বলত, ‘বুঝলি তিতলি, জ্ঞান দেয়া সহজ, কিন্তু কাজ করা কঠিন।’ ব্যাপারটিকে আরও সহজ করার জন্য তিতলিকে মজার মজার সব গল্প শোনাত। বলত শোন, আগেরবার ইউএনডিপির ‘পরিবার পরিকল্পনার’ বিষয়ে সচেতন করতে নোয়াখালির প্রত্যন্ত অঞ্চলে মহিলাদের ব্রিফিং দেওয়ার বছরখানেক পর ফলাফল দেখতে গিয়ে হয়তো দেখতাম আবারও সন্তান কোলে-কাখে দিব্যি ঘুরে বেরাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলে বলত, ‘আফা আন্নেরা যেবায় বেলুন ইগারে ফুলাই বেড়ার লগে ভরি থুই স্বামীর লগে শুইবার কইছেন, আরা হেই বায় শুইছি, হেরপরও বাচ্চা পেডে আই গেলে কী কইতাম আন্নেরাই কন!’ বিষয়টা অবিবাহিত তিতলিনা না বুঝলেও কুমুআপু হেসে লুটুপুটি খেলে, তিতিলির আপুর মতো হতে ইচ্ছে করত। তারও প্রজেক্টের কাজ নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেরাবার ইচ্ছেটা প্রকোট হয়ে উঠত।
প্রজেক্ট শেষে কুমুআপু ফিরে এলে সারাটা দিন তারা মজার সব গল্প করে সময় পার করত।স্বামী, দুই সন্তান আর শাশুড়ি নিয়ে সুখের সংসার কুমুআপুর। স্বামী চাকরি করে বায়িং হাউজে। প্রজেক্টে যাওয়ার আগে আপু বলত, সময় পেলে জয়িতা ও জুইসকে পড়াটা দেখায় দিস সঙ্গে নিজেও পড়িস। এতো করে বললাম এসএসসিটা দে, তাইলে প্রজেক্টের ভাইয়ারে বলে তোকে একটা প্রজেক্ট ধরায়ে দিতাম।’
সেই কুমুআপুকে আজ তিতলির সবচে আপন মনে হলো।কুমুআপুকে কী মোবাইল করবে! নাকি তার কাছে চলে যাবে! সমস্ত নীরবতা ভেঙে গতির দিকে এবং গতির বিপরীতে দুটো ট্রেন চলে গেল। পায়ে পায়ে বেশ কিছুটা পথ চলে আসলে ধারে-কাছে কোথাও মরা জীবজন্তুর দুর্গন্ধ নাকে প্রবেশ করলে তিতলির পেট মোচর দিয়ে নাড়ি-ভুঁড়ি বেরিয়ে আসতে চায়। পেটের সন্তানকে মুক্তি দেবার জন্য দ্রুত দু’দিক শূন্য কোনো জায়গা খোঁজে; তাতে তার শরীরের কাঁটা টুকরোগুলো অন্তত পরিবারের কেউ দেখতে পাবে না।
আদিগম্বর ফ্যাকাশে তারাবিহীন আকাশের নিচে ক্লান্ত অবিশ্রান্ত তিতলি নিজের কষ্ট থেকে পরিত্রাণের জন্য এগিয়ে চলে। ফায়দাবাদ প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়া তিতলি কোনোদিনই বাড়ির বাইরে যায়নি। জীবনের চাওয়া-পাওয়াগুলো প্রজাপতির ডানায় কোনো রঙ মাখেনি। ছোট টিনের চালার মতো একরঙা ছিল তার জীবন। মাঝে মধ্যে তাতে রঙ তুলির ছোঁয়া দিয়েছিল আর কেউ না তার প্রিয় কুমুআপু।
হঠাৎ তিতলির সব পথ অচেনা ঠেকে বলে বোঝে না কোথায় যাচ্ছে বা কোথায় যাবে, শুধু দুটো ট্রেন লাইনের মাঝপথ ধরে আগায়। চার ভাই-বোন ও বাবা-মাসহ ছয়জনের জীবন ভালোই চলছিল। দাদার যে কয় কাঠা জমি ছিল আজ তাদের কিছুই অবশিষ্ট নাই শুধুমাত্র দখলদারদের কারণে। দুই কাঠা জমির উপর একই টিনের নিচে চারটি ভাগের একটিতে কোনোরকম মাথা গোজার ঠাঁইটুকু ছাড়া বাকিগুলো ভাড়া। বড়ভাই তোফাজ্জল কাজ করত সেক্টরে গড়ে ওঠা বিশাল হোটেলে তাই তার চোখ ছিল ঊর্ধ্বমুখী। অন্য দু’ভাই-বোনের মধ্যে শারমিন ক্লাস ফাইভে আর ছুটু ক্লাস ওয়ানে। ক্লাস নাইনের পর তিতলি আর আগাতে পারেনি ছোটবেলায় টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে স্মরণশক্তি কমে যাওয়ায়। আজকের কথা তিতলি কালকে ভুলে যায়। ডালে লবণ হয়নি ভেবে দেখা গেছে দু-তিনবার দিয়ে ফেলেছে। এমন মেয়েকে নিয়ে বাবা-মার চিন্তার শেষ না থাকলেও তেমন গা করত না। কেননা, তাকে দিয়ে অন্তত ঘর দেখাশোনা ও রান্নাবান্নার কাজটা তো হয়!
বাবা-মার উদাসিনতা তিতলি বোঝে, কিন্তু তারাও বা কী করবে! তিতলির ভুলে যাবার রোগের সঙ্গে তুতেনখামেনের রোগের কষ্ট এক এবং একাত্ম হয়ে মিশে যায়। কুমুআপুর সঙ্গে প্রজেক্ট নিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, ভাড়াটিয়া রোজিনা ও জরিনার সঙ্গে কোনোরকম গার্মেন্টেসে ডুকলেও সুবিধা করতে পারেনি। বাড়ি এসে মাকে বলে, দূর আমারে দিয়া এইসব হইত না।’
তাই বলে একদম কিছু করে না বললে ভুল হবে; কুমুআপুর বাচ্চাদের পড়িয়ে শ’পাঁচেক টাকা তার শখ মিটাবার জন্য যথেষ্ট ছিল। ঘর ভাড়া, বড়ভাইয়ের ইনকাম এবং বাবার দোকান সব মিলিয়ে তাদের সংসার যেমন- তেমনের চাইতে ভালোই চলছিল তাদের মা অঞ্জনা বেগমের সমিতি ব্যবসার কারণে। তল্লাটের এমন কেউ নেই যে অঞ্জনা বেগমকে চেনে না। ব্যাংকের রিজার্ভ মানি শেষ হতে পারে, কিন্তু অঞ্জনা বেগমের টাকা কখনও শেষ হয় না। অঞ্জনা বেগমের কাছে সরকারি বেসরকারি সব ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প ফু। ২১০ টাকা দিয়ে ব্যুরো, ব্র্যাক, আশায় ভর্তি হয়ে ৩০০ অথবা ৫০০ টাকা ১ মাসের মধ্যে ডিপিএস করে ৪ সপ্তাহের মধ্যে ৫০০০-১৫০০০ টাকা লোন নিতে পারার যে প্রসেস সেখানে ঠেকায় পড়লে সপ্তাহে হোক না বেশি কিস্তি, তবুও তারা অঞ্জনাকেই খুঁজত। কথায় বলে না-বৃষ্টি পড়ে টিপ টিপ, কিস্তি দিব ঠিক ঠিক। অবশ্য তিতলির মা থুক্যু অঞ্জনা বেগম মাঝে-মধ্যে গলা চড়িয়ে আসমান নামিয়ে আনলেও এনজিও ওয়ালাদের মতো হাড়ি-পাতিল- হালের গরু-নাকফুল-মোবাইল নিয়ে চলে যেত না। সদা ব্যাস্ত অঞ্জনা বেগমের মেয়ের যৌতুক দিয়ে বিদায় দেবার ফুসরত না মিললেও সুদ খেতে খেতে রক্তের চাপ বাড়িয়ে সপ্তাহখানেকের জন্য হসপিটালে শুয়ে গেলে তখনই বিপদ দরজায় কড়া নাড়ে।
সে রাতে টিনের চালের গরম নিচে নেমে আসে। স্ট্যান্ডফ্যান ও সিলিংফ্যান কিছুতেই শরীর জুড়াচ্ছিল না। মোবাইলে কুমুআপুর সঙ্গে গল্প শেষে কেবল চোখটা লেগেছে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে তিতলি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনি।গভীর রাতে ঘরে চাপা গোঙ্গানির শব্দে ঘুম ভেঙে গেলে দুঃস্বপ্ন ভেবে জেগে ওঠে। ‘মোবাইলে ভাই এগুলান কী দ্যাখতাছে! উফ! আল্লাহ, তুমি আমারে কালা বানাইলা না ক্যান?’ ভাইকে ক্রমশ এগিয়ে আসতে দেখে তিতলি ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো চোখ মেলে বলে, আপনে না আমার মায়ের পেডের ভাই লাগেন! এইডা কী করেন!’
চুপ, একদম মুখবন্ধ, কথা কইলে এক কোপে মাথা নামাই দিবাম, ভাই- বোন আবার কী!
তিতলি আকাশের দিকে চাইল, তারাবিহীন আকাশে শীতের কুয়াশা কিছুটা হালকা হলেও উত্তরের হাওয়ায় ঠাণ্ডা লাগলে ওড়নাটা ভালো করে গায়ে পেঁচিয়ে নেয়। কিছু দূরে অনেক লাইট দেখে বুঝতে পারে সামনে কোনো স্টেশন। শেষ মুহুর্তে এবার মনে হলো, মার কাছে ফিরে গিয়ে সব খুলে বলবে! নাকি কুমুআপুর কাছে চলে যাবে! হেরা কী বিশ্বাস করব! তার সন্তান যদি কোন দিন দুইন্নাত আহে , হে কী বিশ্বাস করব!’
মুহূর্তে দুটো লাইনের লাল বাতি জ্বলে উঠলে তিতলি স্টেশনের অভিমুখে দ্রুত পা চালায়।