মূল: আর্থার কোনান ডোয়েল(১৯১৮)
অনুবাদ: ফাইযা ফাতিমা
সে সন্ধ্যার কিছুটা স্পষ্টভাবে আমার মনে পড়ে, বাকিটা যেন অস্পষ্ট, বিচ্ছিন্ন স্বপ্ন। সেটাই এই ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত একটি গল্পকে বর্ণনা করতে কঠিন করে তোলে। এখন আমার লন্ডনে যাওয়ার এবং দেরীতে ফিরিয়ে আনার পেছনে কোন ধারনাই নেই। এটা যেন আমার লন্ডন ভ্রমণ করার অন্যান্য কারণগুলোর সঙ্গে মিশে যায়। কিন্তু ঘর থেকে বেরিয়ে স্টেশন পর্যন্ত আসার সঙ্গেই গোটা চিত্রটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যে জীবনটা আমি আবার যাপন করছি- তার প্রতিটা মুর্হূত।
আমার এখনও মনে পড়ে প্ল্যাটফর্ম দিয়ে হেটে যাওয়া এবং পথের শেষে বড় ঘড়িটির দিকে তাকান। সঙ্গে সঙ্গে মস্ত বড়ো ঘড়ির কাটাগুলো আমাকে জানিয়ে দিত এগারটা বেজে ত্রিশ মিনিট। মনে পড়ে মাঝ রাতের আগে বাড়ি ফিরতে পারব নাকি তা নিয়ে ভাবতে থাকা নিজেকে। তারপর মনে পড়ে আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা জ্বলজ্বলে হেডলাইটওয়ালা একটি বড় গাড়ির কথা, সেটা ছিল আমার নতুন থার্টি-হর্স-পাওয়ার রোবার যা সেদিনই কেবল ডেলিভারি হয়েছিল। আমার ড্রাইভার পার্কিনসকে গাড়ির ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করার কথাও মনে পড়ে। পার্কিনস বলেছিল, গাড়িটি চমৎকার আমার এটাও মনে আছে।
‘ আমি নিজে গাড়ি চালাব,‘ বলে আমি গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লাম।
‘ গিয়ারগুলো সম্ভবত কিছুটা ভিন্ন,’ স্যার, আমিই চালাই।’
`না, গাড়িটা আমি চালিয়ে দেখি।’ বলে আমি আমাদের পাঁচ মাইলের গন্তব্যে যাত্রা শুরু করলাম।
আমার আগের গাড়ির গিয়ার উপরে ওঠার জন্য ভালো ছিলো কিন্তু এই গাড়ির গিয়ার উপরে উঠতে অনেক বিপাকে পড়তে হলো। মনে হয়েছিল আমি খুব শীগ্রই গাড়িটি চালানো শিখে যাব কিন্তু মাঝে মাঝে আমরা বোকা হয়ে যাই। আসলে কি হচ্ছে তা আমরা বুঝতে পারি না। অন্ধকারে মানুষ না দেখতে পেয়ে কখনও কখনও বোকার মতো ঢিল ছোড়ে। এবং পরে তার মাসুল দিতে হয়। ক্লেইস্টল হিলে আসা পর্যন্ত আমি ভালোই চালাচ্ছিলাম। ক্লেইস্টল হিল ইংল্যান্ডের সবচেয়ে নিকৃষ্ট পাহাড়গুলোর মধ্যে একটি। দেড় মাইল লম্বা এবং অত্যন্ত ঢালু এবং তিনটি আচমকা মোড় রয়েছে এই পাহাড়টিতে। আমার বাড়ির গেইটটি ছিল লন্ডন মহাসড়কের একদম গোড়ায়।
আসল বিপদ শুরু হয় পাহাড়ের সর্বাধিক ঢালু জায়গাটিতে পৌছানোর সঙ্গে সঙ্গেই । আমার গাড়ির সর্বোচ্চ স্পীডে ছিল এবং আমি তাকে সেভাবেই ছেড়ে দিলাম। কিন্তু গাড়ির গিয়ার আটকে গেল। আমি তাকে পুনরায় উপরে উঠাতে চাইলাম। সেই সময় গাড়ি ভালোই স্পীডে যাচ্ছিল। তাই আমি দুটি ব্রেকে একত্রে চাপ দিয়ে আবার চেষ্টা করলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার পায়ের ব্রেক ফেল করল কিন্তু তাতে আমার কিছু হলো না। কিন্তু যখন খট করে আওয়াজ হলো আমার তেমন একটা অসুবিধা হলো না। কিন্তু যখন আমার সাইড ব্রেকটি কাজ করা বন্ধ করে দিল আমি কিছুটা অস্থির হয়ে ঘামাতে শুরু করলাম। এবং গাড়ির লিভার ঝন করে উঠল, এর মধ্যে আমরা পাহাড়ের নিম্নগামী। উজ্জ্বল আলোতে আমি রাস্তার প্রথম আচমকা মোড়টি ঠিক মতো পার করতে সক্ষম হলাম। কিন্তু দ্বিতীয়টি পার করাটা একটু মুসকিল ছিল। কিন্তু আমরা পেরেছি, পরবর্তিতে তৃতীয় মোড়টি পার করতেও তেমন একটা অসুবিধা হয়নি। তারপর আমাদের বাড়ির গেইটও। আমি যদি সরাসরি ভেতরে ঢুকে যেতে পারতাম তাহলে সবই ঠিক ছিল। তাহলে পাহাড়ের ঢাল থেকে নেমে গাড়িটা বাড়ির একেবারে সামনে দাঁড়াত।
পার্কিনস চমৎকার আচরণ করল। আমার অবশ্যই এটা জানা উচিত ছিল। সে একদম শান্ত ও সতর্ক ছিল। আমি বাঁকের মুখের রাস্তাটি ব্যবহার করার কথা ভাবছিলাম এবং পার্কিনস তা বুঝতে পারল।
‘আমি এমনটা করব না, স্যার, সে বলল। ‘এই মুহূর্তে আমাদের এভাবেই আগানো উচিৎ।’
অবশ্যই সে ঠিক ছিল। সে ইলেক্ট্রিক সুইচটি বন্ধ করে দিল। গাড়িটি তখন চলমান অবস্থায় ছিল তবুও বেশ উদ্বেগজনক গতিতে যাচ্ছিলাম।
‘ আমি সামলাচ্ছি, যদি আপনি সুযোগ পান লাফ দিয়েন। কেননা এই মোড় আমরা কখনোই পেরুতে পারব না, লাফ দেওয়া ছাড়া উপায় নেই স্যার।’
‘না, বললাম আমি, আমাকে এটা থামাতে হবে। তুমি চাইলে লাফ দিতে পার।’
‘আমি আপনার সাথেই থাকাব স্যার,’ বলল সে।
পুরানা গাড়িটা হলে গিয়ারের লিবার রিভার্সে দিয়ে দেখতাম কি হয়। মনে হয় গিয়ারগুলো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যেত কিন্তু একটা সুযোগ তো থাকত। আমার কিছুই করার ছিল না। পার্কিনস উপরে উঠতে চাচ্ছিল কিন্তু এই গতিবেগে সেটা করা প্রায় অসম্ভব ছিল। গাড়ির চাকাগুলো বাতাসের মতো শোঁ শোঁ আওয়াজ করছিল। গাড়ির লাইট এতো অসাধারণ ছিল যে কেউ এক ইঞ্চি পর্যন্ত নজরে আসছিল। যত ভয়ঙ্কর হোন না কেন আমার মনে আছে দৃশ্যটা অত্যন্ত সুন্দর ছিল। সরু রাস্তাটিতে যে কারো জন্য আমাদের সামনে আসা একটি চমৎকার, দ্রুত, স্বর্ণালী মৃত্যুর মতো ছিল।
বাঁকের মুখে ঘুরতেই গাড়ির একটি চাকা তিন ফিট উঠে গেল। আমরা মোড়টির শেষের দিকে ছিলাম। আমি ভেবেছিলাম পার হতে পারব. কিন্তু পরে গাড়িটি টলমলভাবে কিছুক্ষণের জন্য সুন্দরভাবে এগিয়ে গিয়েছিল। সেটা ছিল তৃতীয় এবং শেষ মোড়। সেখানে শুধু পার্ক গেইটই ছিল। পার্ক গেইটটি আমাদের দিকে মুখ করা ছিল। কিন্তু দুভার্গবশতভাবে সরাসরি না। আমরা প্রধান সড়কে থেকে বিশ গজ বাম দিকে ঘেষে যেতে থাকলাম। সম্ভবত আমি এটা করতে পারতাম, কিন্তু স্টিংয়ারিংটি ঘুরে যাওয়াতে আমরা পাড়ে দিকে এগিয়েছিলাম। চাকাগুলো সহজে ঘুরছিল না। আমরা লেইন থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আমরা বাম দিকে একটি খোলা গেইট দেখলাম। আমি আমার সব্বোর্চ শক্তি প্রয়োগ করে স্টিয়ারিংটি ঘুরাতে চেষ্টা করলাম। পার্কিনস আর আমি এক দিকে ঘেষে রইলাম এবং চোখের পলকে প্রতি ঘন্টায় পঞ্চাশ মাইল গতিতে আমার ডান দিকের চাকা আমার বাড়ির গেইটের ডান দিকের পিলারের সাথে বাড়ি খেলো। প্রচন্ড একটা শব্দ শুনতে পেলাম। কেউ যেন আমাকে আকাশে ছুঁড়ে মারল। তারপর.. এবং তারপর!
কিছুক্ষণ পর রাস্তার পাশে ঝোপ ঝারের ভেতর ওক গাছের ছায়ায় নিজের আস্তিত্ব পুনরায় আবিষ্কার করলাম। আমার পাশে কেউ একজন দাঁড়িয়ে ছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম পার্কিনস কিন্তু আবার তাকিয়ে দেখলাম সে স্ট্যানলি, আমার কলেজের বন্ধু, যার জন্য আমার মনে সব সময় প্রচন্ড মমত্ববোধ ছিল। আমার প্রতি স্ট্যানলির ব্যক্তিত্বে অদ্ভূতভাবে সহানুভূতিশীল ছিল; এবং আমিও অনেকটা গর্বিত ছিলাম যে আমারও তার প্রতি অনুরূপ প্রভাব ছিল। এই মুহূর্তে আমি তাকে দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু মনে হচ্ছিল আমি একটি স্বপ্নের মধ্যে আছি। চারিদিক এতো ঘূর্ণায়মান ও কাপছিলো যে সবকিছুকে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই মেনে নিচিছলাম।
‘কি একটা ধাক্ক! আমি বললাম, `হে ঈশ্বর, কি ভয়ানক অবস্থা!’
সে মাথা নাড়ল এবং সেই আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতেও আমি তার মুখের মৃদু, স্মিত হাসিটি দেখতে পাচ্ছিলাম।
আমি কোন ভাবে নড়তে পারছিলাম না। এমনকি আমার কোন ইচ্ছাও ছিল না। কিন্তু আমার ইন্দ্রিয়গুলো অত্যন্ত সতর্ক ছিল। এবং আমি বিধ্বস্ত গাড়িটি দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি ছোট একটা মানুষের ভিড় এবং ফিসফিসানি শুনতে পাচ্ছিলাম। সেখানে বাড়িওয়ালা এবং তার স্ত্রীর সঙ্গে আরো দু-এক জনও ছিল । তারা আমাকে খেয়াল না করে গাড়ির দিকে বেশ নজর দিচ্ছিল। তারপর আমি হঠাৎ করে একটা বেদনাদায়ক কান্নার আওয়াজ পেলাম।
‘সম্পূর্ণ ভারটা তার উপর, আস্তে উঠাও।’ একজন চিৎকার করে বলল।
‘এটাতো আমার পা মাত্র!’, বলল আরেকজন যাকে আমি পার্কিনস বলে চিনতে পারলাম।
‘সাহেব কোথায়?’, বলে সে কেঁদে উঠল।
‘এই তো আমি,’ আমি জবাব দিলাম, কিন্তু তারা কেউ আমাকে শুনতে পেল না। তারা সবাই গাড়ির সামনে রাখা একটি জিনিসের দিকে ঝুকে ছিল।
স্ট্যানলি আমার কাঁধে হাত রাখল, তার ছোঁয়া অবর্ণনীয়ভাবে শীতল মনে হল, আমি মনে স্বস্তি পেলাম।
‘কোন কষ্ট নেই, নিশ্চয়ই?’ সে বলল।
‘না,’ আমি বললাম।
‘কখনই ছিল না,’ সে বলল।
তারপর হঠাৎ আমার ভেতর দিয়ে একটি আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। স্ট্যানলি! স্ট্যানলি! কিন্তু, স্ট্যানলি তো বোয়ের যুদ্ধে ব্লোমফনটেইনে টাইফয়েড রোগে মারা গিয়েছিল।
‘স্ট্যানলি!’ আমি কাঁদলাম, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল- ‘স্ট্যানলি, তুমি আর বেঁচে নেই।’
সে আগের মতো তার চিন্তিত ও মৃদু হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকাল এবং বলল,‘ আর তুমি।’