দশটিকবিতা
গৃহপ্রবেশ
আমার বাড়ি নির্মিত হল কাল।
আজ গৃহপ্রবেশ, তেজী কাঠামো চুম্বনের ক্ষণ
চৌকাঠ জুড়ে বেপরোয়া ছায়া, সেই ছায়া আক্রমণ
শব্দভুক টবে সাজানো প্রলাপ, গোলাপের রক্তশূন্য ঠোঁটে
আজ শিকারী প্রবেশ, হাঁ হাঁ শূন্যতায় ভরে ফেলা হুল্লোড়।
মহাসমারোহে উদ্বোধিত হল জীবাশ্ম-সৌধ
মিথ্যাভুক পলেস্তারা লেপে উঠেছে প্রতারিত ছাদ
আর আত্মবিক্রিত ইট জুড়ে জুড়ে
শ্বেতনির্মিত শব্দবেশ্যাদের যত্রতত্র প্রলোভনে।
প্রবেশক্ষণে খুব দেহ এঁটে যায়, আঁটসাঁট চৌকাঠে
গৃহস্থ শঙ্কিত তাপে, গৃহে তার অকাল উত্থাণ
উচ্চাশায় তারাদের জানু ছুঁয়ে থাকা গ্রীলবাজ রাতে
প্রবেশ কানাড়া, আজ চাপা পড়ে সায়াহ্ন বুনন।
আর ভরে উঠেছে ঘর, ছোট্ট ঘর, বেঢপ দেহের সমান
অনন্তর বন্ধ চারপাশ, ডালায় পেরেকের ধাতব চুম্বন।
মেঘদল
ঈশ্বর আছেন ওপাড়ে, স্বর্ণস্তম্ভ সহ তাঁর প্রাসাদ উড্ডীন
অন্তঃরীক্ষ জোড়া সিড়ি জুড়ে পদচ্ছাপ, শব্দ শুনি তাঁর।
সে উৎসবে ওরাই চাঁদোয়া, উদ্যানের ফুল, পায়রা ওরাই
পরীদের ওড়না, কাঁচুলী বুকের কিংবা ওরাই পরী।
ঈশ্বরের প্রাসাদে অপরূপ সুরমুগ্ধ রাতের শ্রাবণ
অপ্সরীর বুকে মুখে ঠোঁট ঘষে রঙের কাঙালী।
উর্বশীর নৃত্যপর পা, ওরা মেনকার বুকের ভূগোল
বহুবর্ণা কবুতর, অর্জুনের তীর আর দ্রৌপদীর চুল।
স্বর্ণজল সাঁতরাব
হিরন্ময় চীৎকারে ভরে ফেলব মাঠ সাদাপৃষ্ঠা
খয়েরি বাড়িঘর
ঐ লবঙ্গ লতাটিকে, বাহুমূল ঘিরে উঠেছে যে
ফিনিশীয় কুচি
তার ভাঁজ, বল্গাহীন নদীটির পাড়, আজ খুব
উড়াল দেব, পাখিদের সতত ডানার নীচে
নির্ভার হতে পারিনি ডাঙ্গায়, তাই ঊর্ধ্বে
মানবীয় গম্বুজকে পুতুল বানিয়ে।
যে সাঁকো উল্টে রয়েছে তাকে সোজাসাপ্টা
করে দেব চীৎকারে
সম্পর্কের ঘরে ঘরে ফুঁ, অনন্তর বিশুদ্ধ চীৎকার
তড়িৎ জুড়নে এসে লেগে যায় যে ঠোঁট
সে ঠোঁটের সন্ধি ভেঙ্গে দেব।
আজ সমুদ্রের কাঁখে চড়ে তিমিদের বাড়ী যাব
ধীরগতি তিমিদের দয়ার্দ্র বানাব
উন্মাতাল পাথরে পাথরে নাচা বিষুবীয় রোষে
যে বৃক্ষ খুলে দেয় পাতার পোষাক তাকে ফের
পোষাক পরাব।
যে স্বর্ণজলে ঠেলেনি বুক, সে জলে সাহসী সাঁতরাব।
শিরোনামহীন
মানব হ্রেষায় ক্ষয় ক্ষুর যায় চিরে
বিকীর্ণ রথ নীলাভ্রে তাঁর নিয়ণ টাঙ্গানো পথে
মায়াদর্পণে আত্মাকে বাঁধে তীব্রে
মুখেরপার্শ্বে ছায়াতরুজল, দেবকী আকাশ উঁকি।
জুঁইভোর ডোরে পরাভূত বিষকলা
চোখের হ্রদে অমলিন বন, হাসি ফেলা তাঁর ছায়া
শূন্যের সাঁকো শূন্যে উড়াল, পথাবকাশে ভীড়।
তমোপ্রবাহের তরল রচিত যানে
বুঝিবা বিদ্যুৎ হেনে গেল তাঁর তীর
উচ্ছ্বিতধারা পুণ্যবাহিত জলে।
অপরূপে কুয়াশা ধূসর, ধুলোর পালঙ্কে রাধা
ঘূর্ণিজলের লুপ্ত পাথরে স্বপ্ন-খঁচিত ধাঁধা।
ডাইনোসর
পৃথিবীর তৃণক্ষেত্র সচ্ছল গড়াল তার অতিদীর্ঘ গ্রীবায়
আরবীয় উড়ন্ত গালিচা দন্ত-হাঁয়ের ভেতর, অগভীর জলাশয় ঘিরে
অতিলৌকিক ডানার মর্মর, জিব্রাইলের অশ্বখুরে আঁকা
এই পথে ভূতল কাঁপাল খাটো পর্বতের দল।
কংক্রীট লেজাঘাতে ধ্বস্ত বনভূমি, পালায় পাখিরা
অতল জলে ডুব দিয়ে চুপ মৎস্যদল
ভয়ে ভয়ে কেবলি বাড়িয়ে নেয় সমুদ্রের সীমা
মেঘপুঞ্জ ঊর্ধ্বে আরো, বাতাসের বিভক্ত চলাফেরা।
ভেতরে শীতল রোদ, বরফের বিস্তারিত ক্রোধে
চলে গেছে বিস্মৃতি আর রাত্রির থাবার ভেতর।
এখনো ডাইনোসর উচিয়ে আনে ভয়াল চোয়াল
পৃথিবীর তৃণক্ষেত্র অতলান্ত হাঁয়ের ভেতর
সমস্ত সৌন্দর্যের উপর আজো দেখি
ভয়ঙ্কর সেই গ্রীবা অতিকায়, ভীষণ উচনো।
নিশিপদ্য
খুব স্পষ্ট নয় খুব অস্পষ্ট নয় এমন দিনে
আমরা বেড়াতে গেলাম নিশিকান্দি
জলের ভিত নড়ে গেল, ফোয়ারার মত চতুর্দিকে উড়ল পাখিরা
যেন ঈশ্বরের ফুঁ, মেঘ উড়ছে আকাশের প্রাণ জুড়ে
আর সমসবত কিছুর মধ্যেই তাঁর অনুলিখন দেখে দেখেও
নকলনবিসের মতো সে পদ্যের রূপ তুলি নিবে।
কাদার পাশেই প্রতিমা, তখনো প্রাণ দেয়া হয়নি
বুকের ভেতর নিয়ে গেছি শোক, তখনো কাঁদিনি
হাহুতাশ হাওয়াই তো দিগন্তের দেয়ালে দেয়ালে মাথা ঠুকছে
অপারগতার, বিহ্বলতার, একে বুঝি বেড়ানো বলে?
খুব উজ্জ্বল নয়, খুব অনুজ্জ্বল নয় এমন দিনে
আমরা বেড়াতে গেলাম নিশিকান্দি
কাৎ হতে আছে টিলা, কার্পাসের মত ছড়ালো লোকেরা
যেন মানবিক ফুঁ, হাপরের নীচে বুকভাঙ্গা উঠানামা
অশ্রুময় অন্ধশোক, সরু পদ্যে বিহ্বল পাখি ডাকা…
এখন এই নিশির পাশে দাঁড়িয়ে আমরা হু হু কাঁদছি।
নায়ক
যেন তার নিজস্ব সংলাপ কিন্নরের কণ্ঠ খাঁজে
অবসাদে নেমেছে খাদে
যেন নতজানু নিপুন সৈনিক
মঞ্চে তার সুচতুর পদচ্ছাপ আঁকে।
তিনিই সম্রাট যার সাম্রাজ্য অটুট
স্বপ্ন খুব সহজে টুটেছে
প্রান্তরে ঘূর্ণায়িত, দিগন্ত হটে যায় পিছে
আধেক চেহারা ছিল আঁধার ছড়িয়ে।
সন্ত নন, সন্তপ্ত নন, সন্তনের লাজুক জনক
মঞ্চে এসে ভুলে যান পাঠ
ভূমিকা অন্যের, প্রস্থানের সিড়ির উধাও
প্রহরে অধীর যারা বিব্রত তাদেরও অধিক।
যেন তার প্রবল আকাক্সখা বেয়ে নেমে যায় সাপ
বিলাপে বিশ্রন্ত বন, বনভূমি, চাঁদ
একবার কেঁদে ছিল অহল্যার ভ্রূণে
রাত্রি যায়, জ্যোৎস্নার ধারা যায় সাথে।
দীপক আলোর বিভ্রম
ভোরবেলা দৌড়ে যাই পুবের আকাশে
শরীরে আগুন যার তাঁকে দেখে আসি
বৃক্ষবলী দৌড়ায় সাথে সাথে
অমা বলে, এসোনা নীল নির্জ্জন বীথিকা,
ওরা অভিমানে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।
দিনমান ওদের ওরকম নিশ্চল দেখা যায়,
মানুষেরা তাই দেখে।
অসভ্যতাকে সভ্য পোষাক পরাতে
সন্ধ্যেবেলা অন্য গোলার্ধে পাড়ি দেয় প্রভা,
আঁধারের দীর্ঘ চাদর টেনে নেয়
নতমুখী, অনামিকা গাছগুলো।
ওদের একটু আদর করে, মুখ তুলে চুমু-টুমু খেয়ে
বাড়ি ফেরার জন্য যেই বাড়াই পা
কে আমায় বেণী ধরে দাঁড় করিয়ে দেয়।
রাভর ওরকম হতচকিত দাঁড়িয়ে থাকে দীপা,
ক্রান্তিকাল তাই দেখে।
নিমগ্নে তাঁর বেজেছিল আদিভাতি
হে আয়তবান ধরো নম্রেরই দ্বিধা
হৃদয়পদ্মে নৈঋতজ্বলা অমা
অনন্ত গ্রাস লাফিয়ে নেমেছে তীর
নির্বিকল্পে গেঁথে ফেল ভোর-গাথা।
আধিভৌতিক পূর্নিমা জ্বলে দেহে
আত্মিক বাঁশি ভূমিতে তপ্ত দাহ
উত্থানও আজ বজ্রবাহিত কলা
চিরে নেয় নীল রাহু কেতকীর ডানা।
নিমগ্নে তাঁর বেজেছিল আদিভাতি
চারিভিতে ছায়া দ্বৈতাদ্বৈত ভুলে
শস্যের শিরে বিধূর অণিমা শোক
গত নিশীথের চন্দ্রউদিত দিশা।
ইতিহাসে নিঃসঙ্গ
ইতিহাসের মোড়ে কখন হয়ে যাব স্ট্যাচু এক
প্রসিদ্ধ পেতল মূর্তির পাশে দাঁড়াব সংশয়হীন
পাথুরে শরীরে।
এখন হাওয়াও তাচ্ছিল্য মেখে যায়
মেঘ উড়ে যায় ফলবান মাথার ছাদে
ফ্যাকাশে জ্যোৎস্নায় চাঁদের কার্পণ্য পাই টের,
এত যে ডাক দিই, তবু নারী ঘুরিয়ে নেয় মুখ
নিঃসঙ্গতায় শতব্যঙ্গ ঢালে উপেক্ষার কৌতুক।
এ শরীর ছুঁয়ে গেলে জাতচ্যুত হবিরে বাতাস
ও মেঘ আসিস না ছায়াজল নিয়ে
আমাকে ঘেরাও করে বনভূমি হারাবে নোলক
এ চোখে রাখলে চোখ অন্ধ হয়ে যাবে হে প্রিয়া।
এ লোকালয়, নিসর্গকোল, ছায়া ঠোঁটে না দিয়ে আশ্রয়
ঐ দেখ ইতিহাসের চৌরাস্তায় একাকী স্ট্যাচুর মত
সবাই আমায় কেমন দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।
Good
আমার জন্মদিনে দশটি কবিতা মুদ্রিত করে দ্রাঘিমা যে শুভেচ্ছা জানাল তা কৃতজ্ঞ করলো আমাকে।
কবিতাগুলোর লাইনের মাঝে ফাঁক বেশি হয়ে গেছে আর অবলুপ্ত হয়েছে স্তবক। এটা ঠিক করে নিলে ভালো।
শুভ জন্মদিন কবি
কবিতা গুলো অসাধারণ